পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

छा०ान-यादी 8 SA কাল রাত্রেই জাহাজের বন্দরে পৌছবার কথা ছিল, কিন্তু এইখানটায় সমুদ্রবাহী জলের স্রোত প্রবল হয়ে উঠল এবং বাতাসও বিরুদ্ধ ছিল, তাই পদে পদে দেরি হতে লাগল । জায়গাটাও সংকীর্ণ ও সংকটময় । কাপ্তেন সমস্ত রাত জাহাজের উপরতলায় গিয়ে সাবধানে পথের হিসাব করে চলেছেন । আজ সকালেও মেঘবৃষ্টির বিরাম নেই। সূর্য দেখা দিল না, তাই পথ ঠিক করা কঠিন । মাঝে মাঝে ঘণ্টা বেজে উঠছে, এঞ্জিন থেমে যাচ্ছে, নাবিকের দ্বিধা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে । আজ সকালে আহারের টেবিলে কাপ্তেনকে দেখা গেল না । কাল রাত দুপুরের সময় কাপ্তেন একবার কেবল বর্ষাতি পরে নেমে এসে আমাকে বলে গেলেন, ডেকের কোনো দিকেই শোবার সুবিধা হবে না, কেননা, বাতাসের বদল হচ্ছে । এর মধ্যে একটি ব্যাপার দেখে আমার মনে বড়ো আনন্দ হয়েছিল । জাহাজের উপর থেকে একটা দড়িবাধা চামড়ার চোঙে করে মাঝে মাঝে সমুদ্রের জল তোলা হয় । কাল বিকেলে এক সময় মুকুলের হঠাৎ জানতে ইচ্ছা হল, এর কারণটা কী । সে তখনই উপরিতলায় উঠে গেল । এই উপরিতলাতেই জাহাজের হালের চাকা, এবং এখানেই পথনির্ণয়ের সমস্ত যন্ত্র । এখানে যাত্রীদের যাওয়া নিষেধ । মুকুল যখন গেল তখন তৃতীয় অফিসর কাজে নিযুক্ত । মুকুল তাকে প্রশ্ন করতেই তিনি ওকে বোঝাতে শুরু করলেন । সমুদ্রের মধ্যে অনেকগুলি স্রোতের ধারা বইছে, তাদের উত্তাপের পরিমাণ স্বতন্ত্র । মাঝে মাঝে সমুদ্রের জল তুলে তাপমান দিয়ে পরীক্ষা করে সেই ধারাপথ নির্ণয় করা দরকার। সেই ধারার ম্যাপ বের করে তাদের গতিবেগের সঙ্গে জাহাজের গতিবেগের কী রকম কাটাকাটি হচ্ছে, তাই তিনি মুকুলকে বোঝাতে লাগলেন । তাতেও যখন সুবিধা হল না, তখন বোর্ডে খড়ি দিয়ে ঐকে ব্যাপারটাকে যথাসম্ভব সরল করে দিলেন । কোনো বিলিতি জাহাজে মুকুলের পক্ষে এটা কোনোমতেই সম্ভবপর হত না ; সেখানে মুকুলকে অত্যন্ত সোজা করেই বুঝিয়ে দিত যে, ও জায়গায় তার নিষেধ। মোটের উপরে জাপানি অফিসরের দিয়ে মানুষের গতিবিধি আছে। অথচ নিয়মটা চাপা পড়ে যায় নি, তাও বার বার দেখেছি। জাহাজ যখন বন্দরে স্থির ছিল, যখন উপরিতলার কাজ বন্ধ, তখন সেখানে বসে কাজ করবার জন্যে আমি কাপ্তেনের সম্মতি পেয়েছিলুম। সেদিন পিয়ার্সন সাহেব দুজন ইংরেজ আলােপীকে জাহাজে নিমন্ত্রণ করেছিলেন । ডেকের উপর মাল তোলার শব্দে এভুজ সাহেব বিরক্ত হয়ে হঠাৎ প্রস্তাব করলেন, উপরের তলায় যাওয়া যাক । আমি সম্মতির জন্য প্রধান অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলুম ; তিনি তখনই বললেন, “না।” নিয়ে গেলে কাজের ক্ষতি হত না, কেননা, কাজ তখন বন্ধ ছিল । কিন্তু নিয়মভঙ্গের একটা সীমা আছে, সে সীমা বন্ধুর পক্ষে যেখানে অপরিচিতের পক্ষে সেখানে না। উপরের তলা ব্যবহারের সম্মতিতেও আমি যেমন খুশি হয়েছিলুম, তার বাধাতেও তেমনি খুশি হলুম। স্পষ্ট দেখতে পেলুম, এর মধ্যে দক্ষিণ্য আছে, কিন্তু দুর্বলতা নেই। বন্দরে পৌছবামাত্র জাপান থেকে কয়েকখানি অভ্যর্থনার টেলিগ্রাম ও পত্র পাওয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে প্রধান অফিসর এসে আমাকে বললেন, এ-যাত্রায় আমাদের সাঙঘাই যাওয়া হল না, একেবারে এখান থেকে জাপান যাওয়া হবে । আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কেন । তিনি বললেন, জাপানবাসীরা আপনাকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে প্ৰস্তুত হয়েছে, তাই আমাদের সদর আপিস থেকে টেলিগ্রামে আদেশ এসেছে, অন্য বন্দরে বিলম্ব না করে চলে যেতে । সাঙঘাইয়ের সমস্ত মাল আমরা এইখানেই নামিয়ে দেব, অন্য জাহাজে করে সেখানে যাবে । এই খবরটি আমার পক্ষে যতই গৌরবজনক হােক, এখানে লেখবার দরকার ছিল না । কিন্তু আমার লেখবার কারণ হচ্ছে এই যে, এই ব্যাপারের একটু বিশেষত্ব আছে ; সেটা আলোচ্য। সেটা পুনশ্চ ঐ একই কথা । অর্থাৎ ব্যাবসার দাবি সচরাচর যে-পাথরের পাচিল খাড়া করে আত্মরক্ষা করে, এখানে তার মধ্যে দিয়েও মানবসম্বন্ধের আনাগোনার পথ আছে । এবং সে পথ কম প্ৰশান্ত নয় । জাহাজ এখানে দিন দুয়েক থাকবে । সেই দুদিনের জন্যে শহরে নেবে হােটেলে থাকবার প্রস্তাব