পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 \OO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সে তো হিংসা নয় । আমরা অনেক আচার, অনেক আসবাব যুরোপের কাছ থেকে নিয়েছি- সব সময়ে প্রয়োজনের খাতিরে নয়, কেবলমাত্র সেগুলো যুরোপীয় বলেই। য়ুরোপের কাছে আমাদের মনের এই যে পরাভব ঘটেছে অভ্যাসবশত সেজন্যে আমরা লজ্জা করতেও ভুলে গেছি। য়ুরোপের যত বিদ্যা আছে সবই যে আমাদের শেখাবার, এ কথা মানি ; কিন্তু যত ব্যবহার আছে সবই যে আমাদের নেবার, এ কথা আমি মানি নে । তবু, যা নেবার যোগ্য জিনিস তা সব দেশ থেকেই নিতে হবে, এ কথা বলতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু সেইজন্যেই, জাপানে যে-সব ভারতবাসী এসেছে তাদের সম্বন্ধে একটা কথা আমি বুঝতে পারি নে। দেখতে পাই, তারা তো যুরোপের নানা অনাবশ্যক নানা কুগ্ৰী জিনিসও নকল করেছে, কিন্তু তারা কি জাপানের কোনো জিনিসই চোখে দেখতে পায় না । তারা এখান থেকে যে-সব বিদ্যা শেখে সেও যুরোপের বিদ্যা, এবং যাদের কিছুমাত্র আর্থিক বা অন্যরকম সুবিধা আছে তারা কোনোমতে এখান থেকে আমেরিকায় দৌড় দিতে চায় । কিন্তু যে-সব বিদ্যা এবং আচার ও আসবাব জাপানের সম্পূর্ণ নিজের, তার মধ্যে কি আমরা গ্রহণ করবার জিনিস কিছুই দেখি নে । আমি নিজের কথা বলতে পারি, আমাদের জীবনযাত্রার উপযোগী জিনিস আমরা এখান থেকে যত নিতে পারি। এমন যুরোপ থেকে নয়। তা ছাড়া জীবনযাত্রার রীতি যদি আমরা অসংকোচে জাপানের কাছ থেকে শিখে নিতে পারতুম, তা হলে আমাদের ঘরদুয়ার এবং ব্যবহার শুচি হত, সুন্দর হত, সংযত হত । জাপান ভারতবর্ষ থেকে যা পেয়েছে তাতে আজ ভারতবর্ষকে লজ্জা দিচ্ছে, কিন্তু দুঃখ এই যে, সেই লজ্জা অনুভব করবার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের যত লজ্জা সমস্ত কেবল যুরোপের কাছে, তাই য়ুরোপের ছেড়া কাপড় কুড়িয়ে কুড়িয়ে তালি-দেওয়া অদ্ভুত আবরণে আমরা লজ্জা রক্ষা করতে চাই । এদিকে জাপানপ্রবাসী ভারতবাসীরা বলে, জাপান আমাদের এশিয়াবাসী বলে অবজ্ঞা করে, অথচ আমরাও জাপানকে এমনি অবজ্ঞা করি যে, তার আতিথ্য গ্ৰহণ করেও প্রকৃত জাপানকে চক্ষেও দেখি নে, জাপানের ভিতর দিয়ে বিকৃত যুরোপকেই কেবল দেখি । জাপানকে যদি দেখতে পেতুম তা হলে আমাদের ঘর থেকে অনেক কুশ্রাতা, অশুচিতা, অব্যবস্থা, অসংযম আজ দূরে চলে যেত । বাংলাদেশে আজ শিল্পকলার নূতন অভ্যুদয় হয়েছে, আমি সেই শিল্পীদের জাপানে আহবান করছি। নকল করবার জন্যে নয়, শিক্ষা করবার জন্যে । শিল্প জিনিসটা যে কত বড়ো জিনিস, সমস্ত জাতির সেটা যে কত বড়ো সম্পদ, কেবলমাত্র শৌখিনতাকে সে যে কতদূর পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে—তার মধ্যে জ্ঞানীর জ্ঞান, ভক্তের ভক্তি, রসিকের রসবোধ যে কত গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে আপনাকে প্ৰকাশ করবার চেষ্টা করেছে, তা এখানে এলে তবে স্পষ্ট বোঝা যায় । টােকিওতে আমি যে-শিল্পীবন্ধুর বাড়িতে ছিলুম। সেই টাইক্কানের নাম পূর্বেই বলেছি ; ছেলেমানুষের মতো তার সরলতা, তার হাসি র্তার চারি দিককে হাসিয়ে রেখে দিয়েছে। প্ৰসন্ন তার মুখ, উদার তীর হৃদয়, মধুর তার স্বভাব । যতদিন তার বাড়িতে ছিলুম, আমি জানতেই পারি নি। তিনি কত বড়ো শিল্পী । ইতিমধ্যে য়োকোহামায় একজন ধনী এবং রসজ্ঞ ব্যক্তির আমরা আতিথ্য লাভ করেছি। তার এই বাগানটি নন্দনবনের মতো এবং তিনিও সকল বিষয়ে এখানকারই যোগ্য । তার নাম হারা । তার কাছে শুনলুম, য়োকোয়াম টাইক্কান এবং তানজান শিমোমুরা আধুনিক জাপানের দুই সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী । তারা আধুনিক যুরোপের নকল করেন না, প্ৰাচীন জাপানেরও না । তারা প্রথার বন্ধন থেকে জাপানের শিল্পকে মুক্তি দিয়েছেন । হারার বাড়িতে টাইক্কানের ছবি যখন প্রথম দেখলুম, আশ্চর্য হয়ে গেলুম। তাতে না আছে বাহুল্য, না আছে শৌখিনতা । তাতে যেমন একটা জোর আছে তেমনি সংযম | বিষয়টা এই- চীনের একজন প্ৰাচীন কালের কবি ভাবে ভোর হয়ে চলেছে ; তার পিছনে একজন . বালক একটি বীণাযন্ত্র বহু যত্নে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে তার নেই ; তার পিছনে একটি বাকা উইলো গাছ। জাপানে তিনভাগওয়ালা যে খাড়া পর্দার প্রচলন আছে সেই রেশমের পর্দার উপর আঁকা ; মস্ত পর্দা এবং প্রকাণ্ড ছবি। প্রত্যেক রেখা প্ৰাণে ভরা। এর মধ্যে ছােটােখাটাে কিংবা জবড়জঙ্গ কিছুই নেই ; যেমন উদার তেমনি গভীর, তেমনি আয়াসহীন । নৈপুণ্যের কথা একেবারে