পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাপান-যাত্রী 8 ○ ) মনেই হয় না ; নানা রঙ নানা রেখার সমাবেশ নেই ; দেখবামাত্র মনে হয় খুব বড়ো এবং খুব সত্য । তার পরে তার ভূদৃশ্যচিত্র দেখলুম। একটি ছবি— পটের উচ্চপ্ৰান্তে একখানি পূর্ণ চাদ, মাঝখানে একটি নীেকা, নীচের প্রান্তে দুটাে দেওদার গাছের ডাল দেখা যাচ্ছে ; আর কিছু না, জলের কোনো রেখা পর্যন্ত নেই । জ্যোৎস্নার আলোয় স্থির জল কেবলমাত্র বিস্তীর্ণ শুভ্রতা- এটা যে জল সে কেবলমাত্র ঐ নীেকাটি আছে বলেই বোঝা যাচ্ছে ; আর, এই সর্বব্যাপী বিপুল জ্যোৎস্নাকে ফলিয়ে তোেলবার জন্যে যত কিছু কালিমা সে কেবলই ঐ দুটাে পাইন গাছের ডালে । ওস্তাদ এমন একটা জিনিসকে আঁকতে চেয়েছেন যার রূপ নেই, যা বৃহৎ এবং নিস্তব্ধ- জ্যোৎস্নারাত্রি- অতলস্পর্শ তার * নিঃশব্দতা । কিন্তু, আমি যদি তার সব ছবির বিস্তারিত বর্ণনা করতে যাই তা হলে আমার কাগজও ফুরোবে, সময়েও কুলোবে না । হারাসান সবশেষে নিয়ে গেলেন একটি লম্বা সংকীর্ণ ঘরে ; সেখানে প্ৰকাণ্ড ছবি । শীতের পরে প্রথম বসন্ত এসেছে ; প্লাম গাছের ডালে একটাও পাতা নেই, সাদা সাদা ফুল ধরেছে, ফুলের পাপড়ি ঝরে ঝরে পড়ছে ; বৃহৎ পর্দার এক প্রান্তে দিগন্তের কাছে রক্তবর্ণ সূর্য দেখা দিয়েছে, পর্দার অপর প্রান্তে প্লাম গাছের রিক্ত ডালের আড়ালে দেখা যাচ্ছে একটি অন্ধ হাতজোড় করে। সূর্যের বন্দনায় রত । একটি অন্ধ, এক গাছ, এক সূৰ্য, আর সোনায়-ঢালা এক সুবৃহৎ আকাশ ; এমন ছবি আমি কখনো দেখি নি । উপনিষদের সেই প্রার্থনাবাণী যেন রােপ ধরে আমার কাছে দেখা দিলেতমসো মা জ্যোতিৰ্গময় । কেবল অন্ধ মানুষের নয়। অন্ধ প্রকৃতির এই প্রার্থনা, তমসো মা জ্যোতিগময়- সেই প্লাম গাছের একাগ্র প্রসারিত শাখাপ্ৰশাখার ভিতর দিয়ে জ্যোতিলোকের দিকে উঠছে । অথচ, আলোয় আলোময়- তারি মাঝখানে অন্ধের প্রার্থনা । কাল শিমোমুরার আর-একটা ছবি দেখলুম। পটের আয়তন তো ছোটাে, অথচ ছবির বিষয় বিচিত্র । সাধক তার ঘরের মধ্যে বসে ধ্যান করছে ; তার সমস্ত রিপুগুলি তাকে চারি দিকে আক্রমণ করেছে। অর্ধেক মানুষ অর্ধেক জন্তুর মতো তাদের আকার, অত্যন্ত কুৎসিত, তাদের কেউ বা খুব সমারোহ করে আসছে, কেউ বা আড়ালে আবডালে উকিঝুকি মারছে । কিন্তু, তবু এরা সবাই বাইরেই মতো। কিন্তু, লক্ষ্য করে দেখলেই দেখা যায়, সে সাচ্চা বুদ্ধ নয়— স্কুল তার দেহ, মুখে তার বঁাকা হাসি । সে কপট আত্মম্ভরিতা, পবিত্র রূপ ধরে এই সাধককে বঞ্চিত করছে । এ হচ্ছে আধ্যাত্মিক অহমিকা, শুচি এবং সুগভীর মুক্তস্বরূপ বুদ্ধের ছদ্মবেশ ধরে আছে ; একেই চেনা শক্ত, এই হচ্ছে অন্তরতম রিপু, অন্য কদৰ্য রিপুরা বাইরের । এইখানে দেবতাকে উপলক্ষ করে মানুষ আপনার প্রবৃত্তিকে পূজা করছে। আমরা র্যার আশ্রয়ে আছি, সেই হারাসান গুণী এবং গুণজ্ঞ । তিনি রসে হাস্যে ঔদার্যে পরিপূর্ণ। সমুদ্রের ধারে, পাহাড়ের গায়ে, তার এই পরম সুন্দর বাগানটি সর্বসাধারণের জন্যে নিত্যই উদঘাটিত । মাঝে মাঝে বিশ্রামগৃহ আছে, যে-খুশি সেখানে এসে চা খেতে পারে । একটা খুব লম্বা ঘর আছে, সেখানে যারা বনভোজন করতে চায় তাদের জন্যে ব্যবস্থা আছে। হারাসানের মধ্যে কৃপণতাও নেই, আড়ম্বরও নেই, অথচ তার চার দিকে সমারোহ আছে। মূঢ় ধনাভিমানীর মতো তিনি মূল্যবান জিনিসকে কেবলমাত্র সংগ্রহ করে রাখেন না ; তার মূল্য তিনি বোঝেন, তার মূল্য তিনি দেন, এবং তার কাছে তিনি সম্রামে আপনাকে নত করতে জানেন । X (? এশিয়ার মধ্যে জাপােনই এই কথাটি একদিন হঠাৎ অনুভব করলে যে, য়ুরোপ যে-শক্তিতে পৃথিবীতে সর্বজয়ী হয়ে উঠেছে একমাত্র সেই শক্তির দ্বারাই তাকে ঠেকানাে যায়। নইলে তার চাকার নীচে - পড়তেই হবে এবং একবার পড়লে কোনোকালে আর ওঠবার উপায় থাকবে না ।