পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 vo N ববীন্দ্র-বচনাবলী এই কথাটি যেমনি তার মাথায় ঢুকল অমনি সে আর এক মুহুর্ত দেরি করলে না । কয়েক বৎসরের মধ্যেই য়ুরোপের শক্তিকে আত্মসাৎ করে নিলে । যুরোপের কামান-বন্দুক কুচ-কাওয়াজ, থেকে পূৰ্বলোকে একেবারে আস্ত উপড়ে এনে বসিয়ে দিলে। নতুন শিক্ষাকে ক্রমে ক্রমে সাইয়ে নেওয়া, বাড়িয়ে তোলা নয় ; তাকে ছেলের মতো শৈশব থেকে যৌবনে মানুষ করে তোলা নয়তাকে জামাইয়ের মতো একেবারে পূর্ণ যৌবনে ঘরের মধ্যে বরণ করে নেওয়া । বৃদ্ধ বনস্পতিকে এক জায়গা থেকে তুলে আর-এক জায়গায় রোপণ করবার বিদ্যা জাপানের মালীরা জানে ; য়ুরোপের শিক্ষাকেও তারা তেমনি করেই তার সমস্ত জটিল শিকড় এবং বিপুল ডালপালা সমেত নিজের দেশের মাটিতে এক রাত্রির মধ্যেই খাড়া করে দিলে । শুধু যে তার পাতা ঝরে পড়ল না তা নয়, পরদিন থেকেই তার ফল ধরতে লাগল। প্রথম কিছুদিন ওরা য়ুরোপ থেকে শিক্ষকের দল ভাড়া করে এনেছিল । অতি অল্পকালের মধ্যেই তাদের প্রায় সমস্ত সরিয়ে দিয়ে, হালে এবং দাড়ে নিজেরাই বসে গেছে— কেবল পালটা এমন আড় ক’রে ধরেছে যাতে পশ্চিমের হাওয়াটা তার উপরে পুরো এসে লাগে । ইতিহাসে এতবড়ো আশ্চর্য ঘটনা আর কখনো হয় নি । কারণ, ইতিহাস তো যাত্রার পালা গান করা নয় যে, ষোলো বছরের ছোকরাকে পাকা গোপদাড়ি পরিয়ে দিলেই সেই মুহুর্তে তাকে নারদমুনি করে তোলা যেতে পারে । শুধু যুরোপে অস্ত্র ধার করলেই যদি য়ুরোপ হওয়া যেত, তা হলে আফগানিস্থানেরও ভাবনা ছিল না । কিন্তু, য়ুরোপের আসবাবগুলো ঠিকমত ব্যবহার করবার মতো মনোবৃত্তি জাপান এক নিমেষেই কেমন করে গড়ে তুললে, সেইটেই বোঝা শক্ত । সুতরাং এ-কথা মানতেই হবে, এ জিনিস তাকে গোড়া থেকে গড়তে হয় নি, ওটা তার একরকম গড়াই ছিল । সেইজন্যেই যেমনি তার চৈতন্য হল অমনি তার প্রস্তুত হতে বিলম্ব হল না । তার যা-কিছু বাধা ছিল সেটা বাইরের ; অর্থাৎ, একটা নতুন জিনিসকে বুঝে পড়ে আয়ত্ত করে নিতে যেটুকু বাধা সেইটুকু মাত্র ; তার নিজের অন্তরে কোনো বিরোধের বাধা ছিল না। পৃথিবীতে মোটামুটি দুরকম জাতের মন আছে— এক স্থাবর আর-এক জঙ্গম । এই মানসিক স্থাবর-জঙ্গমতার মধ্যে একটা ঐকান্তিক ভেদ আছে, এমন কথা বলতে চাই নে। স্থাবরকেও দায়ে পড়ে চলতে হয়, জঙ্গমকেও দায়ে পড়ে দাড়াতে হয় । কিন্তু স্থাবরের লয় বিলম্বিত, আর জঙ্গমের লয় দ্রুত । জাপানের মনটাই ছিল স্বভাবত জঙ্গম ; লম্বা লম্বা দশকুশি তালের গাম্ভারি চাল তার নয় । এইজন্যে সে এক দৌড়ে দু-তিন শো বছর হু হু করে পেরিয়ে গেল। আমাদের মতো যারা দুর্ভাগ্যের বোঝা নিয়ে হাজার বছর পথের ধারে বটতলায় শুয়ে গড়িয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে, তারা অভিমান করে বলে, “ওরা ভারি হালকা, আমাদের মতো গাভীর্য থাকলে ওরা এমন বিশ্ৰীীরকম দৌড়ধাপ করতে পারত না । সঁচা জিনিস কখনো এত শীঘ্ৰ গড়ে উঠতে পারে না ।” আমরা যাই বলি-না কেন, চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এশিয়ার এই প্ৰান্তবাসী জাত যুরোপীয় সভ্যতার সমস্ত জটিল ব্যবস্থাকে সম্পূৰ্ণ জোরের সঙ্গে এবং নৈপুণ্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারছে । এর একমাত্র কারণ, এরা যে কেবল ব্যবস্থাটাকেই নিয়েছে তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে মনটাকেও পেয়েছে। নইলে পদে পদে অস্ত্রের সঙ্গে অস্ত্রীর বিষম ঠোকাঠুকি বেধে যেত ; নইলে ওদের শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষার লড়াই কিছুতেই মিটত না, এবং বর্ম ওদের দেহটাকে পিষে দিত । মনের যে-জঙ্গমতার জোরে ওরা আধুনিক কালের প্রবল প্রবাহের সঙ্গে নিজের গতিকে এত সহজে মিলিয়ে দিতে পেরেছে সেটা জাপানি পেয়েছে কোথা থেকে । জাপানিদের মধ্যে একটা প্ৰবাদ আছে যে, ওরা মিশ্র জাতি । ওরা একেবারে খাস মঙ্গোলীয় নয় । এমন-কি, ওদের বিশ্বাস ওদের সঙ্গে আর্যরক্তেরও মিশ্রণ ঘটেছে । জাপানিদের মধ্যে মঙ্গোলীয় এবং ভারতীয় দুই ছাদেরই মুখ দেখতে পাই, এবং ওদের মধ্যে বর্ণেরও বৈচিত্ৰ্য যথেষ্ট আছে। আমার চিত্রকর বন্ধু টাইকানকে বাঙালি কাপড় পরিয়ে দিলে, তাকে কেউ জাপানি বলে সন্দেহ করবে না ।