পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 N. রবীন্দ্র-রচনাবলী মনুর মতে যখন বনে যাবার সময় তখন হাজির হতে হল দরকারের দরবারে । সভা সমিতি আমার কাছে সরকারি কাজ আদায় করতে লেগে গেল । এতেই বোধ হচ্ছে, আমার শনির দশা । কবি হন বা কলাবিৎ হন তারা লোকের ফরমাশ টেনে আনেন- রাজার ফরমাশ, প্রভুর ফরমাশ, বহুপ্ৰভুর সমাবেশরাপী সাধারণের ফরমাশ । ফরম্যাশের আক্রমণ থেকে তাদের সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি নেই। তার একটা কারণ, অন্দরে তারা মানেন সরস্বতীকে, সদরে তাদের মেনে চলতে হয় লক্ষ্মীকে । সরস্বতী ডাক দেন অমৃতভাণ্ডারে, লক্ষ্মী ডাক দেন অন্নের ভাণ্ডারে । শ্বেতপদ্মের অমরাবতী আর সোনার পদ্মের অলকাপুরী ঠিক পাশাপাশি নেই। উভয়ত্রই যাদের ট্যাক্সো দিতে হয়, এক জায়গায় খুশি হয়ে, আরেক জায়গায় দায়ে পড়ে, তাদের বড়ো মুশকিল। জীবিকা অর্জনের দিকে সময় দিলে ভিতরমহলের কাজ চলে না । যেখানে ট্রামের লাইন বসাতে হবে সেখানে ফুলের বাগানের আশা করা মিথ্যে । এই কারণে ফুলবাগানের সঙ্গে আপিসের রাস্তার একটি আপস হয়েছে এই যে, মালি জোগাবে ফুল আর ট্রামলাইনের মালেক জোগাবে অন্ন । দুৰ্ভাগ্যক্রমে যে-মানুষ অন্ন জোগায় মর্তলোকে তার প্রতাপ বেশি। কারণ, ফুলের শখ পেটের জ্বালার সঙ্গে জবরদস্তিতে সমকক্ষ নয় । শুধু কেবল অন্ন-বস্ত্ৰ আশ্রয়ের সুযোগটাই বড়ো কথা নয় । ধনীদের যে-টাকা তার জন্যে তাদের নিজের ঘরেই লোহার সিন্দুক আছে, কিন্তু গুণীদের যে-কীর্তি তার খনি যেখানেই থাক তার আধার তো তাদের নিজের মনের মধ্যেই নয় । সে-কীর্তি সকল কালের, সকল মানুষের । এইজন্য তার এমন একটি জায়গা পাওয়া চাই যেখান থেকে সকল দেশকালের সে গোচর হতে পারে । বিক্রমাদিত্যের রাজসভার মঞ্চের উপর যে-কবি ছিলেন সেদিনকার ভারতবর্ষে তিনি সকল রসিকমণ্ডলীর সামনে দাড়াতে পেরেছিলেন ; গোড়াতেই তার প্রকাশ আচ্ছন্ন হয় নি । প্ৰাচীনকালে অনেক ভালো কবির ভালো কাব্যও দৈবক্রমে এইরকম উচু ডাঙাতে আশ্রয় পায় নি বলে কালের বন্যাস্রোতে ভেসে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই । এ কথা মনে রাখতে হবে, যারা যথার্থ গুণী তারা একটি সহজ কবচ নিয়ে পৃথিবীতে আসেন। ফরমাশ তাদের গায়ে এসে পড়ে, কিন্তু মর্মে এসে বিদ্ধ হয় না । এইজন্যেই তারা মারা যান না, ভাবীকালের জন্যে টিকে থাকেন। লোভে পড়ে ফরমাশ যারা সম্পূর্ণ স্বীকার করে নেয়। তারা তখনই বঁচে, পরে মরে । আজ বিক্ৰমাদিত্যের নবরত্বের অনেকগুলিকেই কালের ভাঙাকুলো থেকে খুঁটে বের নগদ পাওনা নিশ্চয়ই আর-সকলের চেয়ে বেশি ছিল । কিন্তু, কালিদাস ফরমাশ খাটতে অপটু ছিলেন বলে দিঙনাগের স্কুল হস্তের মাের তাকে বিস্তর খেতে হয়েছিল। তাকেও দায়ে পড়ে মাঝে মাঝে ফরমাশ খাটতে হয়েছে, তার প্রমাণ পাই মালবিকাগ্নিমিত্রে । যে দুই-তিনটি কাব্যে কালিদাস রাজাকে মুখে বলেছিলেন “যে আদেশ, মহারাজ । যা বলছেন তা-ই করব” অথচ সম্পূৰ্ণ আরেকটা কিছু করেছেন, সেইগুলির জোরেই সেদিনকার রাজসভার অবসানে তার কীর্তিকলাপের অন্ত্যেষ্টিসৎকার হয়ে যায় নি- চিরদিনের রসিকসভায় তার প্রবেশ অবারিত হয়েছে । মানুষের কাজের দুটাে ক্ষেত্র আছে- একটা প্রয়োজনের, আর-একটা লীলার । প্রয়োজনের তাগিদ। সমস্তই বাইরের থেকে, অভাবের থেকে ; লীলার তাগিদ ভিতর থেকে, ভাবের থেকে । বাইরের ফরম্যাশে এই প্রয়োজনের আসর সরগরম হয়ে ওঠে, ভিতরের ফরম্যাশে লীলার আসর। জমে । আজকের দিনে জনসাধারণ জেগে উঠেছে ; তার ক্ষুধা বিরাট, তার দাবি বিস্তর । সেই বহুরসনধারী জীব তার বহুতরো ফরমাশে মানবসংসারকে রাত্রিদিন উদ্যত করে রেখেছে ; কত তার আসবাব আয়োজন, পাইক বীরকন্দাজ, কাড়া-নাকড়া-ঢাকঢোলের তুমুল কলরব- তার “চাই চাই” শব্দের গর্জনে স্বৰ্গমর্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল । এই গর্জনটা লীলার আসরেও প্ৰবেশ করে দাবিপ্রচার করতে থাকে যে, “তোমাদের বীণা, তোমাদের মৃদঙ্গও আমাদের জয়যাত্রার ব্যান্ডের সঙ্গে মিলে আমাদের কল্লোলকে ঘনীভূত করে তুলুক।” সেজন্যে সে খুব বড়ো মজুরি। আর জঁাকালো শিরোপা দিতেও রাজি আছে । আগেকার রাজসভার চেয়ে সে হকিও দেয় বেশি দামও দেয় বেশি । সেইজন্যে ঢাকির পক্ষে এ