পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 রবীন্দ্র-রচনাবলী । আমি প্রচার করতে পারি। সেই বাণী বহন করাই আমার পক্ষে সত্য কাজ, এবং সেই সত্য কাজের দ্বারাই আমি ভারতের সত্য সেবা করতে পারি। আমি জানতুম, জনসাধারণ টিলককে পোলিটিক্যাল নেতারূপেই বরণ করেছিল এবং সেই কাজেই তাকে টাকা দিয়েছিল । এইজন্য আমি তার পঞ্চাশ হাজার টাকা গ্ৰহণ করতে পারি নি । তার পরে, বোম্বাই-শহরে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল । তিনি আমাকে পুনশ্চ বললেন, “রাষ্ট্রনীতিক ব্যাপার থেকে নিজেকে পৃথক রাখলে তবেই আপনি নিজের কাজ সুতরাং দেশের কাজ করতে পারবেন ; এর চেয়ে বড়ো আর কিছু আপনার কাছে প্রত্যাশাই করি নি।” আমি বুঝতে পারলুম, টিলক যে গীতার ভাষ্য করেছিলেন সে কাজের অধিকার তার ছিল ; সেই অধিকার মহৎ। অধিকার । অনেক ধনী আছে যারা নিজের ভোগেই নিজের অর্থের ব্যয় ও অপব্যয় করে থাকে। সাধারণের দাবি তাদের ভোগের তহবিলে যদি ভাঙন ধরাতে পারে তাতে দুঃখের কথা কিছুই নেই। অবকাশ । পদার্থটা হচ্ছে সময়ধন- সংসারী এই ধনটাকে নিজের ঘরসংসারের চিন্তায় ও কাজে লাগায়, আর কুঁড়ে যে সে কোনো কাজেই লাগায় না । এই সংসারী বা কুঁড়ের অবকাশের উপর লোকহিতের দোহাই দিয়ে উপদ্রব্য করলে দোষের হয় না। আমার অবকাশের অনেকটা অংশ আমি কুঁড়েমিতেই খাটাই, বাইরে থেকে কেউ কেউ এমন সন্দেহ করে । এ কথাটা জানে না যে, কুঁড়েমিটাই আমার কাজের প্ৰধান অঙ্গ । পেয়ালার যতটা চীনেমাটি দিয়ে গড়া ততটাই তার প্রধান অংশ নয়, বস্তুত সেটাই তার গৌণ ; যতটা তার ফাক ততটাই তার মুখ্য অংশ। ঐ ফাকটাই রসে ভরতি হয়, পোড়া চীনেমাটি উপলক্ষ মাত্র । ঘরের খুঁটিটা যেমন, গাছ ঠিক তেমন জিনিস নয়। অর্থাৎ, সে কেবলমাত্র নিজের তলাটার মাটিতেই দাড়িয়ে থাকে না। তার দৃশ্যমান গুড়ি যতটুকু মাটি জুড়ে থাকে তার অদৃশ্য শিকড় তার চেয়ে অনেক বেশি মাটি অধিকার করে বলেই গাছটা রসের জোগান পায় । আমাদের কাজও সেই গাছের মতো ; ফ্ৰাকা অবকাশের তলা থেকে গোপনে সে রস আদায় করে নেয় । দশে মিলি তার সেই বিধিদত্ত অবকাশের লাখেরাজের উপর যদি খাজনা বসায় তা হলে তার সেই কাজটাকেই নিঃস্ব করা হতে থাকে । এইজন্যেই দেশের সমস্ত সাময়িক পত্রে হরির লুঠের জোগান দেবার জন্যে অন্য কোনো দেশেই কবিকে নিয়ে এমনতরো টানাহেঁচড়া করে না । আমাদের দেশের গাৰ্হস্থ্য ব্যাকরণে র্যারা কর্তা তাদের প্রধান পরিচয় ক্রিয়াকর্মে। লোকে তাদের দশকমা বলে । সেই গাহঁস্তেস্থ্য আবার এমন সব লোক আছে যারা অকৰ্মা ; তারা কেবল ফাইফরমাশ খাটে । কাজের চেয়ে অকাজে তাদের বেশি দরকার। অর্থাৎ, তাস খেলবার যখন জুড়ি না জোটে তখন তাদের ডাক পড়ে, আর দূর-সম্পর্কের জ্যাঠাইমার গঙ্গাযাত্রার সময় তারাই প্ৰধান সহায় । আমাদের শাস্ত্ৰে গৃহস্থ-আশ্রমের উপর আরণ্য-আশ্রমের বিধি । বর্তমানকালে এই শেষের আশ্রম বাদ পড়েছে ; আরণ্য-আশ্রম নেই, কিন্তু তার জায়গা জুড়েছে সাধারণ্য-আশ্রম। এখন দেশে আরণ্যক পাতায় না, কিন্তু সাধারণাকের সংখ্যা কম নয়। ঠাৱা পাবলিক নামক বৃহৎ সংসারের ঘোরতর সংসারা । শেষোক্ত সংসারেও দুই দলের লোক আছেন। একদল দশকর্ম, আর-একদল অকৰ্মা ; যাদের ইংরেজিতে লীডার বলে আমি তাদের বলতে চাই কর্তব্যক্তি। কেউ বা বড়ো-কর্তা, কেউ বা মেজো-কর্তা, কেউ বা ছোটাে-কর্তা । এই কর্তারা নিত্য-সভা, নৈমিত্তিক-সভা, যুদ্ধ-সভা, শ্ৰাদ্ধ-সভা প্রভৃতিতে সর্বদাই ব্যস্ত ; তাছাড়া আছে সাময়িক পত্র, অসাময়িক পত্র, চাদার খাতা, বার্ষিক বিবরণী । আর, র্যারা এই সাধারণ্য আশ্রমের কর্তব্যক্তি নন, ক্রিয়াকর্ম তাদের অধীন নয়, তারা থাকেন চ-বৈ-তু-হি নিয়ে ; যত রকম জোড়াতাড়া দেওয়ার কাজে তাদের ডাক ; হঠাৎ ফাক পড়লে সেই ফাক উপস্থিতমত র্তারা পূরণ করে থাকেন। তারা ভলান্টিয়ারি করেন, চৌকি সাজান, চান্দা সাধেন, করতালিঘাতে সভার উৎসাহবৃদ্ধি করেন, কখনো বা অপঘাতে সভার অকাল-সমাপ্তি-সাধনেও যোগ foN | পাব্লিক শহরে কর্তৃপদ হাটে ঘাটে মেলে না, আর সাবধানে তাদের ব্যবহার করতে হয় । কিন্তু