পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 NA রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ২৫শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪ কাল সমস্তদিন জাহাজ মাল বোঝাই করছিল । রাত্রে যখন ছাড়ল তখন বাতাসের আক্ষেপ কিছু শান্ত । কিন্তু, তখনো মেঘগুলো দল পাকিয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে। আজ সকালে একখানা ভিজে অন্ধকারে আকাশ ঢাকা । এবার আলোকের অভিনন্দন পেলুম না । শরীরমনও ক্লান্ত । ” জাহাজটা তীর থেকে যেন একটুকরো সংসার ছিন্ন করে নিয়ে ভেসে চলেছে। ডাঙায় মানুষে মানুষে ফাক থাকবার অবকাশ আছে ; এখানে জায়গা অল্প, ঘেঁষাৰ্ঘেষি করে থাকতে হয় । কিন্তু, তবু পরস্পর পরিচয় কত কঠিন । প্রত্যেকবার জাহাজে ওঠবার আগে এই চিন্তাটি মনকে পীড়া দেয়, এই নৈকট্যর দূরত্ব, এই সঙ্গবিহীন সাহচর্য। - আদিম অবস্থায় মানুষ যে-বাসা বাধে তার দেয়াল পাতলা ; তার ছিটে বেড়ায় যথেষ্ট ফাক, ঝাপটা ঠেলে ফেলে। ঘরে ঢোকা সহজ । কালক্রমে বাসা বাধবার নৈপুণ্য তার যতই বেড়ে ওঠে, ততই ইটকাঠি-লোহাপাথরে ঘরের দেয়াল পাকা হয়ে ওঠে, দরজা হয় মজবুত । তার মধ্যে মনের অভ্যোসগুলো হয়ে যায় পাচিলে ঘেরা । খাওয়া-পরা শোওয়া-বসা সব-কিছুর জন্যই আড়ালের দরকার হয় । এই আড়ালটা সভ্যতার সর্বপ্রধান অঙ্গ । এইটেকে রচনা ও রক্ষা করতে বিস্তর খরচ লাগছে । ঘর-বাহিরের মাঝখানে মানুষের সহজ-চলাচলের রাস্তায় পদে-পদে নিষেধ । নিজের বিশেষত্বের সম্পদ ব্যর্থ হয়ে যায় । নিজেকে বিচ্ছিন্ন না করলে নিজেকে প্ৰকাশ করাই যায় না । বীজ। আপনাকে প্ৰকাশ করবার জন্যই মাটির ভিতরে আড়াল খোজে ; ফল আপনাকে পরিণত করবার জন্যেই বাহিরের দিকে একটা খোসার পর্দা টেনে দেয় । বর্বর অবস্থায় মানুষের ব্যক্তিগত বিশেষত্বের জোর থাকে না, তার কাজও থাকে কম। এইজন্যেই ব্যক্তিবিশেষের গোপনতার পরিবেষ্টন সৃষ্ট হয়ে ওঠে তার সভ্যতার উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে । কিন্তু, এই বেড়া জিনিসটার আত্মপ্রাধান্যবোধ ক্ৰমেই অতিমাত্র বাড়তে থাকে। তখন মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনে যে একান্ত প্রয়োজন আছে, সেটা বাধাগ্ৰস্ত হয়ে অনভ্যস্ত হয়ে ওঠে । সেই আতিশয্যাটাই হল বিপদ । এই মারাত্মক বিপদটা কোন অবস্থায় ঘটে । ভোগের আদর্শ অপরিমিত বেড়ে উঠে মানুষের যখন বিস্তর উপকরণের প্রয়োজন, যখন অন্যের জন্যে তার সময় ও সম্বল খরচ করবার বেলায় বিস্তর হিসেব করা অনিবাৰ্য, যখন তার জীবিকার উপাদান উৎপাদন করবার জন্যে প্রভূত আয়োজন চাই, তখন তার সভ্যতার বাহন-বাহিনীর বিপুলতায় তার লোকালয় অতি প্ৰকাণ্ড হয়ে ওঠে । জনতার পরিমিত আয়তনেই মানুষের মধ্যে আত্মীয়তার ঐক্য সম্ভবপর। তাই পল্লীর অধিবাসীরা কেবল যে একত্র হয় তা নয়, তারা এক হয়। শহরের অতিবৃহৎ জনসমাবেশ আপন অতিবিস্তীর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে এক-আত্মীয়তার রক্তস্রোত সঞ্চারিত করবার উপযুক্ত হৃৎপিণ্ড তৈরি করে উঠতে পারে না । প্ৰকাণ্ড জনসঙ্ঘ কাজ চালাবারই যোগ্য, আত্মীয়তা চালাবার নয় । কারখানা ঘরে হাজার লোকের মজুরি দরকার, পরিবারের মধ্যে হাজার লোকের জটিলা হলে তাকে আর গৃহ বলে না। যন্ত্রের মিলন যেখানে সেখানে অনেক লোক, আর অন্ত্রের মিলন যেখানে সেখানে লোকসংখ্যা কম । তাই শহর আমরা আজন্মকাল সেই দেয়াল-কোটরে ভাগে ভাগে বিভক্ত সভ্য মানুষ । হঠাৎ এসে ঠেসাঠেসি। করে মিলেছি। এক জাহাজে । মেলবার অভ্যোস মনের মধ্যে নেই । তীর্থে যারা দল বেঁধে রাস্তায় চলে মিলতে তাদের সময় লাগে না ; তারা গায়ের লোক, মেলাই তাদের অভ্যোস। সার্থবাহ যারা মরুর মধ্য দিয়ে উটে চড়ে চলে তারাও মনকে নীরব আড়ালের বুরখা দিয়ে ঢেকে চলে না ; তাদের সভ্যতা ইট-পাথরে অমিলকে পাকা করে গেঁথে তোলে নি । কিন্তু, স্টীমারের যাত্রী, রেলগাড়ির প্যাসেঞ্জার বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে আসে তাদের দেওয়ালগুলোর সূক্ষ্মী শরীর তাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলতে থাকে ।