পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88しr রবীন্দ্র-রচনাবলী ঘরে সূর্যের আলো ঠেকিয়ে রাখবার জন্যে যখন পর্দা, কখনো বা অর্ধেক কখনো বা সম্পূর্ণ নামিয়ে দেয় তখন সেটাকে আমি ঔদ্ধত্য বলে মনে করি । প্ৰাণের যোগ নয়তো কী । সূর্যের আলোর ধারা তো আমাদের নাড়ীতে নাড়ীতে বইছে। আমাদের প্ৰাণমন, আমাদের রূপরস, সবই তো উৎসরূপে রয়েছে ঐ মহাজ্যোতিষ্কের মধ্যে। সৌরজগতের সমস্ত ভাবীকাল একদিন তো পরিকীর্ণ হয়েছিল ওরই বহিবাম্পের মধ্যে । আমার দেহের কোষে কোষে ঐ তেজই তো শরীরী, আমার ভাবনার তরঙ্গে তরঙ্গে ঐ আলোই তো প্রবহমান । বাহিরে ঐ আলোরই বর্ণচ্ছটায় মেঘে মেঘে পত্রে পুষ্পে পৃথিবীর রূপ বিচিত্র ; অন্তরে ঐ তেজই মানসভােব ধারণ করে আমাদের চিন্তায় ভাবনায় বেদনায় রাগে অনুরাগে রঞ্জিত । সেই এক জ্যোতিরই এত রঙ, এত রূপ, এত ভাব, এত রস। ঐ যে-জ্যোতি আঙুরের গুচ্ছে গুচ্ছে এক-এক চুমুক মদ হয়ে সঞ্চিত সেই জ্যোতিই তো আমার গানে গানে সুর হয়ে পুঞ্জিত হল। এখনই আমার চিত্ত হতে এই যে চিন্তা ভাষার ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে, সে কি সেই জ্যোতিরই একটি চঞ্চল চিন্ময়স্বরূপ নয়। যে-জ্যোতি বনস্পতির শাখায় শাখায় স্তব্ধ ওঙ্কার ধবনির মতো সংহত হয়ে আছে । হে সূৰ্য, তোমারই তেজের উৎসের কাছে পৃথিবীর অন্তৰ্গঢ় প্রার্থনা ঘাস হয়ে, গাছ হয়ে আকাশে উঠছে, বলছে, জয় হােক ! বলছে, অপাবৃণু, ঢাকা খুলে দাও ! এই ঢাকা-খোলাই তার প্রাণের লীলা, এই ঢাকা-খোলাই তার ফুলফলের বিকাশ। অপাবৃণু, এই প্রার্থনারই নিবািরধারা আদিম জীবাণু থেকে যাত্রা করে আজ মানুষের মধ্যে এসে উপস্থিত, প্ৰাণের ঘাট পেরিয়ে চিত্তের ঘাটে পাড়ি দিয়ে চলল। আমি তোমার দিকে বাহু তুলে বলছি, হে পূষন, হে পরিপূর্ণ, অপােবৃণু, তোমার হিরন্ময় পাত্রের আবরণ খোলো, আমার মধ্যে যে গুহাহিত সত্য তোমার মধ্যে তার অবারিত জ্যোতিঃস্বরূপ দেখে নিই। আমার পরিচয় আলোকে আলোকে উদঘাটিত হােক । ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪ আজ মেঘ সম্পূৰ্ণ কেটে গেছে । আলোকের দাক্ষিণ্য আজ আকাশে বিস্তীর্ণ, রৌদ্রচকিত সমুদ্রের তরঙ্গে তরঙ্গে আজ আমন্ত্রণের ইঙ্গিত। সুরলোকের আতিথ্য থেকে আজ একটুও বঞ্চিত হতে ইচ্ছা! করছে না । , আজকের দিনে কি ডায়ারি লিখতে একটুও মন সরে । ডায়ারি লেখাটা কৃপণের কাজ। প্রতিদিন থেকে ছোটাে বড়ো কিছুই নষ্ট না হােক, সমস্তই কুড়িয়ে-কুড়িয়ে রাখি, এই ইচ্ছে ওতে প্ৰকাশ পায় । কৃপণ। এগতে চায় না । আগলাতে চায় । বিধাতা আমাকে মস্ত একটি বর দিয়েছেন, সে হচ্ছে আমার অসামান্য বিস্মরণশক্তি । সংবাদের ভাণ্ডারঘরের জিন্মে। তিনি আমার হাতে দেন নি । প্রহরীর কাজ আমার নয় ; আমাকে আমার মনিব প্রহরে প্রহরে ভুলে যাবার অধিকার দিয়েছেন । ভুলে যেতে দেওয়া যদি হারিয়ে যেতে দেওয়া হত তা হলে তিনি তেমন বিষম ভুল করতেন না । চলে যায় ; সেই ভুলের ফাঁকা রাস্তা দিয়েই ফুলের দল তাদের নবজন্মের সিংহদ্বার খোলা পায় । আমার চৈতন্যের উপরের তলায় আমি এত বেশি ভুলি যে, তাতে আমার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় ভারি অসুবিধা হয় । কিন্তু, আমার ভোলা সামগ্ৰীগুলো চৈতন্যের রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে নীচের তলায় নেপথ্যে এসে জড়ো হয় ; সেখানে নতুন-নতুন বেশপরিবর্তনের সুযোগ ঘটে । আমার মনটাকে বিধাতা নাট্যশালা করতে ইচ্ছা করেছেন, তাকে তিনি জাদুঘর বানাতে চান না । তাই, জমা করে পাওয়া আমার লোকসান, হারিয়ে হারিয়ে পাওয়াই আমার লাভ । এই হারিয়ে যাওয়ার ভিতর দিয়ে এক যখন আর সেজে এসে হাজির হয় তখন তীব্রু স্মরণশক্তিওয়ালা বৈজ্ঞানিক যদি সওয়ালজবাব করতে শুরু করে,