পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 G SR রবীন্দ্র-রচনাবলী “না, ডায়ারি লিখবই।” কিন্তু, লেখবার আছে কী । কিছুই না, যা-তা লিখতে হবে । সকল লেখার সেরা হচ্ছে যা-তা লেখা । যথেচ্ছাচারের অধিকার রাজার অধিকার । বিশেষ কোনো—একজনকে চিঠি লেখবার একটা প্ৰচ্ছন্ন বীথিকা যদি সামনে পাওয়া যেত তা হলে তারই নিভৃতচ্ছায়ার ভিতর দিয়ে আমার নিরুদ্দেশ বাণীকে অভিসারে পাঠাতুম। কিন্তু সে বীথিকা আজ নেই। তাই অপরিচিত ক্যাবিনে আলো জ্বেলে নিজের কাছেই নিজে বকতে বসলুম। আলাপের এই অদ্বৈতরােপ আমার পছন্দসই নয়। সংসারে যখন মনের মতো দ্বৈত দুর্লভ হয়ে ওঠে তখনই মানুষ অদ্বৈতসাধনায় মনকে ভুলিয়ে রাখতে চায় । কারণ, সকলের চেয়ে দুর্বিপাক হচ্ছে অ-মনের মতো Ca75 । হারুন-মারু জাহাজ voor GYC63 se S8 আমার ডায়ারিতে মেয়ে-পুরুষের কথা নিয়ে যে আলোচনা ছিল সে সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠেছে এই যে, “আচ্ছা বোঝা গেল যে, প্ৰাণের টানে মেয়ে আটকা পড়েছে আর পুরুষ ছুটেছে মনের তাড়ায় । তার পরে, তারা যে প্ৰেমে মেলে সেটা কি ঠিক একজাতের ” গোড়াতেই বলে রাখা ভালো যে, প্ৰাণই বল আর মনই বল, মেয়ে কিংবা পুরুষের একেবারে নিজস্ব দখলে নেই। অবস্থগতিকে পক্ষাভেদে একটা মুখ্য, অন্যটা গৌণ । মন জিনিসটা প্ৰাণের ঘরেই মানুষ, প্ৰাণের অন্ন খেয়ে ; সেই জন্যেই অন্তরে অস্তরে তার একটা অকৃতজ্ঞতা আছে। প্ৰাণের আনুগত্য ছাড়িয়ে একাধিপত্য করবার জন্যে সে প্রায় মাঝে মাঝে আস্ফালন করে । এই বিদ্রোহটা ভিতরে ভিতরে কম বেশি পরিমাণে প্ৰায় সব পুরুষের মধ্যেই আছে। প্ৰাণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে তার কিছু-না-কিছু কসরত এবং কুচকাওয়াজ চলছেই। খামকা প্ৰাণটাকে ক্লিষ্ট করবার, বিপন্ন করবার লোভ পুরুষের । ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার শখটা পুরুষের ; তার একমাত্র কারণ ঘরের খাওয়াতে তাকে প্ৰাণের শাসন মানতে হয়। কিন্তু বনের মোষ তাড়ানোতে, প্ৰাণের প্রতি তার যে রাজভক্তি নেই, এইটে প্রচার করবার একটা উপলক্ষ জোটেসেটাকে সে পৌরুষ মনে করে । পুরুষ যুদ্ধ করে এসেছে সব সময়ে যে প্রয়োজন আছে বলে তা নয়, কেবল স্পর্ধা ক’রে এইটে দেখাবার জন্যে যে, প্ৰাণের তাগিদকে সে গ্রাহাই করে না । এই জন্যে যুদ্ধ করার মতো এত বড়ো একটা গোয়ারের কাজকে পুরুষ চিরকালই অত্যন্ত বেশি সমাদর করেছে ; তার কারণ এ নয় যে, হিংসা করাটাকে সে ভালো মনে করে ; তার কারণ এই যে নানাপ্রকার লোভের ও ভয়ের বন্ধনে প্রাণ র্তাকে বেঁধে রাখবার যে বিস্তৃত আয়োজন করে রেখেছে সেইটােকে সে বিনা প্রয়োজনেও অস্বীকার করতে পারলে গর্ব বোধ করে । আমার ভ্রাতুষ্পপুত্রের একটি শিশু বালক আছে, তাকে দেখি, আমাদের বাড়িতে যে জায়গাটা স্থিতির পক্ষে সব চেয়ে অযোগ্য, পৃথিবীর ভারাকর্ষণশক্তিটাকে অশ্রদ্ধা জানানো ছাড়া যেখানে ওঠবার আর কোনো হেতুই নেই, সেইখানেই সে চড়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে ভারাকর্ষণশক্তিও তাকে ছেড়ে কথা কয় নি, কিন্তু তবু তাকে দমিয়ে দিতে পারলে না । এমনি করে বিদ্রোহে সে হাত পাকাচ্ছে আর-কি । মনে আছে, ছেলেবেলায় আমাদের তেতালার ছাদের সংকীর্ণ কানিসটার উপর দিয়ে চলে যাওয়াটাকে উচুদরের খেলা বলে মনে করতুম । ভয় করত না বলে নয়, ভয় করত বলেই । ভয় নামক প্ৰাণের পাহারাওয়ালাটা ঠিক সেই মোড়ের মাথায় দেখা দিত বলেই তাকে ব্যঙ্গ করাটা মজা বলে মনে হত । পুরুষের মধ্যে এই যে কাণ্ডটা হয়, এ সমস্তই মনের চক্রান্তে । সে বলে, “প্ৰাণের সঙ্গে আমার নন-কো-অপারেশন যতই পাকা হবে ততই আমার মুক্তি হবে সহজ ।” কেন রে বাপু, প্ৰাণ তোমার কী