পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8G 8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী প্রয়োজন ; নির্ভরের জন্যে নয়, আরামের জন্যে নয়, ভোগের জন্যে নয়— মুক্তির জন্যে । কেননা, আত্মপ্রকাশের পূর্ণতাতেই মুক্তি । পূর্বেই বলেছি, মেয়েদের এই সৃষ্টির কেন্দ্রগত জ্যোতির উৎস হচ্ছে প্ৰেম । এই প্রেম নিজের স্মৃর্তির জন্যে, সার্থকতার জন্যে, যাকে চায় সেই জিনিসটি হচ্ছে মানুষের সঙ্গ । প্রেমের সৃষ্টিক্ষেত্র নিঃসঙ্গ নির্জনে হতেই পারে না, সে ক্ষেত্র সংসারে । ব্ৰহ্মার সৃষ্টিক্ষেত্র হতে পারে শূন্যে, কিন্তু বিষ্ণুর শক্তি খাটে লোকজগতে । নারী সেই বিষ্ণুর শক্তি, তার সৃষ্টিতে ব্যক্তিবিশেষের প্রাধান্য : ব্যক্তিবিশেষের তুচ্ছতাও প্রেমের কাছে মূল্যবান । ব্যক্তি বিশেষের ছোটােবড়ো বিচিত্র দাবির সমস্ত ক্ষুধার নানা চাওয়া মেয়ের প্রেমের উদ্যমকে কেবলই জাগিয়ে রেখে দেয় । যে পুরুষ আপন দাবিকে ছোটাে করে সে খুব ভালো লোক হতে পারে, কিন্তু মেয়েকে সে পীড়া দেয়, অপূৰ্ণ করে রাখে । এই জন্যে দেখা যায়, যে পুরুষ দৌরাত্ম্য করে বেশি মেয়ের ভালোবাসা সেই পায় বেশি। নারীর প্ৰেম যে পুরুষকে চায় তাকে প্রত্যক্ষ চায়, তাকে নিরস্তর নানা আকারে বেষ্টন করবার জন্যে সে ব্যাকুল । মাঝখানে ব্যবধানের শূন্যতাকে সে সইতে পারে না । মেয়েরাই যথার্থ অভিসারিকা । যেমন করেই হােক, যত দুৰ্গমই হােক, বিচ্ছেন্দ পার হবার জন্য তাদের সমস্ত প্ৰাণ ছটফট করতে থাকে। এই জন্যেই সাধনারত পুরুষ মেয়ের এই নিবিড় সঙ্গবন্ধনেব টান এডিয়ে অতি নিরাপদ দূরত্বের মধ্যে পালাতে ইচ্ছা করে । পূর্বেই বলেছি, আপন পূর্ণতার জন্যে প্রেম ব্যক্তিবিশেষকে চায় । এই ব্যক্তিবিশেষ জিনিসটি অত্যন্ত বাস্তব জিনিস। তাকে পেতে গেলে তার সমস্ত তুচ্ছ খুঁটিনাটির কোনোটাকে বাদ দেওয়া চলে না, তার দোষ ক্রটিকেও মেনে নিতে হয় । ব্যক্তিরূপের উপর ভাবের আবরণ টেনে দিয়ে তাকে অপরূপ করে তোলা প্রেমের পক্ষে অনাবশ্যক । অভাবকে অসম্পূর্ণতাকে প্ৰেম কামনা করে, নইলে তার নিজের সম্পূর্ণতা সফল হবে কিসে।। চেয়ে গণেশের পরে দুর্গার স্নেহ বেশি । এমন-কি, লম্বোদরের অতি অযোগ্য ক্ষুদ্র বাহিনটার পরে কার্তিকের খোশপোশাকি ময়ুর লোভদৃষ্টি দেয় বলে তার পেখমের অপরূপ সৌন্দর্য সত্ত্বেও তার উপরে তিনি বিরক্ত ; ঐ দীনাত্মা ইদুরটা যখন তার ভাণ্ডারে ঢুকে তার ভাডগুলোর গায়ে সিদ্ধ কাটতে থাকে তখন হেসে তিনি তাকে ক্ষমা করেন । শাস্ত্ৰনীতিজ্ঞ পুরুষবর নন্দী বলে, “মা, তুমি ওকে শাসন কর না, ও বড়ো প্রশ্রয় পাচ্ছে ।” দেবী স্নিগ্ধকণ্ঠে বলেন, “আহা, চুরি করে খাওয়াই যে ওর স্বধর্ম, তা ওর দোষ কী ! ও যে চোরের দাত নিয়েই জন্মেছে, সে কি বৃথা হবে ।” বাক্যের অপূর্ণতাকে সংগীত যেমন আপন রসে পূৰ্ণ কবে তোলে, প্ৰেম তেমনি সুযোগ্যতার অপেক্ষা করে না, অযোগ্যতার ফাকের মধ্যে সে নিজেকে ঢেলে দেবার সুযোগ পায় । । মেয়েদের সৃষ্টির আলো যেমন এই প্ৰেম তেমনি পুরুষের সৃষ্টির আলো কল্পনাবৃত্তি । পুরুষের চিত্ত আপন ধ্যানের দৃষ্টি দিয়ে দেখে, আপনি ধ্যানের শক্তি দিয়ে গড়ে তোলে । We are the dreamers of dreams- এ কথা পুরুষের কথা । পুরুষের ধ্যানই মানুষের হতিহাসে নানা কীর্তির মধ্যে নিরস্তর রূপ পরিগ্রহ করছে । এই ধ্যান সমগ্রকে দেখতে চায় বলেই বিশেষের অতিবাহুল্যকে বর্জন করে : যে-সমস্ত বাজে খুঁটিনাটি নিয়ে বিশেষ, সেইগুলো স্পর্মগ্রতার পথে বাধার মতো জমে ওঠে । নারীর সৃষ্টি ঘরে, এইজন্যে সব-কিছুকেই সে যত্ন করে জমিয়ে রাখতে পারে ; তার ধৈর্য বেশি কেননা, তার ধারণার জায়গাটা বড়ো । পুরুষের সৃষ্টি পথে পথে, এই জন্যে সব-কিছুর ভার লাঘব করে দিয়ে সমগ্রকে সে পেতে ও রাখতে চায় । এই সমগ্রের তৃষ্ণা, এই সমগ্রের দৃষ্টি, নির্মম পুরুষের কত শত কীর্তিকে বহুব্যয়, বহুত্যাগ, বহু পীড়নের উপর স্থাপিত করেছে। পুরুষ অমিতব্যয়ী, সে দুঃসাহসিক লোকসানের ভিতর দিয়ে লাভ করতে কুষ্ঠিত হয় না । কারণ, তার ধ্যান সমস্ত লোকসানকে পেরিয়ে সমগ্র লাভটাকে সুস্পষ্ট দেখে ; ছোটাে ছোটাে ক্ষতি তার কাছে নগণ্য হয়ে যায় । পুরুষের কল্পনাবৃত্তির