পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8(? ど 4. রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু, বাস্তব সত্য বলে কোনাে জিনিস কি সৃষ্টিতে আছে। সে সত্য যদি বা থাকে। তবে এমন সম্পূর্ণ নির্বিকার মন কোথায় পাওয়া যাবে যার মধ্যে তার বিশুদ্ধ প্রতিবিম্ব পড়তে পারে ! মায়াই তো সৃষ্টি ; সেই সৃষ্টিকেই যদি অবাস্তব বল তা হলে অনাসৃষ্টি আছে কোন চুলোয় ? তার নাগাল পাবে কোন পণ্ডিত ? নানা ছলা কলায় হাবে-ভাবে সাজে-সজ্জায় নারী নিজের চার দিকে যে-একটি রঙিন রহস্য সৃষ্টি করে তুলেছে সেই আবরণটা ছাড়িয়ে নিয়ে দেখাই তাকে সত্য দেখা, একথা মানি নে । গোলাপ ফুলের মায়ার পর্দাটা তুলে ফেলে তাকে কার্বন নাইট্রোজেন বলে দেখা যেমন সত্য দেখা নয়, এও তেমনি । তুমি বাস্তববাদী বলবে, গোলাপ ফুলের মায়া অকৃত্রিম, মেয়ের মায়া কৃত্ৰিম । একেবারেই বাজে কথা । মেয়ে নিজের হাতে রঙ বেঁটে যখন তার কাপড় রাঙায় তখন তার হাতের গোপনে সেই প্রকৃতিই থাকে যে প্রকৃতি সকলের অগোচরে প্রজাপতির পাখায় নিজের অদৃশ্য তুলি বুলিয়ে দেয়। প্ৰাণের রাজ্যে মায়ার খেলা কত বর্ণে গন্ধে রসে, কত লুকোচুরিতে, আভাসে ইশারায় দিনরাত প্ৰকাশ পাচ্ছে। প্রকৃতির। সেই সকল নিত্য অথচ অনিত্য চঞ্চলতায়, সেই সব নিরর্থক হাবভাবেই তো বিশ্বের সৌন্দৰ্য । চিরপলাতকের এই চিরপরিবর্তনশীল লীলা থেকে বাদ দিয়ে যে অতি সারবান ভারবান নিশ্চল ধুলোমাটি লোহাপাথরের পিণ্ডটা বাকি থাকে তাকেই তুমি বাস্তবসত্য বল না কি । বসনে ভূষণে, আড়ালে আবডালে, দ্বিধায় দ্বন্দ্বে, ভাবে ভঙ্গিতে মেয়ে তো মায়াবিনীই বটে। তার মায়ার জগতে সে ইন্দ্ৰজাল বিস্তার করেছে— যেমন মায়া যেমন ইন্দ্ৰজাল জলে স্থলে, ফুলে ফলে, সমুদ্র পর্বতে, ঝড়ে বন্যায় । সঙ্গে মিলে পুরুষের সামনে এসে দাঁড়াল। এই নারী একটা বাস্তবের পিণ্ডমাত্র নয় ; এর মধ্যে কলাসৃষ্টির একটা তত্ত্ব আছে ; অগোচর একটি নিয়মের বাধনে ছন্দের ভঙ্গিতে সে রচিত ; সে একটি অনির্বচনীয় সুসমাপ্তির মূর্তি । নানা বাজে খুঁটিনাটিকে সে মধুর নৈপুণ্যে সরিয়ে দিয়েছে ; সাজে-সজ্জায় চালে-চলনে নানা ব্যঞ্জনা দিয়ে নিজেকে সে বস্তুলোকের প্রত্যন্তদেশে রসলোকের অধিবাসিনী করে দাড় করিয়েছে। “কাজ করে থাকি।” এই কথাটা জানিয়ে পুরুষ হাত খালি রেখেছে ; মেয়ে সেই হাতে কঁােকন। পরে জানিয়েছে, “আমি তো কাজ করি নে, আমি সেবা করি।” সেবা হল হৃদয়ের সৃষ্টি, শক্তির চালনা নয়। যে রাস্তায় চলবে সেই রাস্তােটাকে খুব স্পষ্ট করে নিরীক্ষণ করবার জন্যে পুরুষ তার চোখদুটাে খুলে রেখেছে, ওটাকে সে গভীর ভাষায় বলে দর্শনেন্দ্ৰিয় । মেয়ে সেই চোখে একটু কাজলের রেখা টেনে দিয়ে বলেছে, চোখ দিয়ে বাইরের জিনিস দেখা যায়। এইটেই চরম কথা নয়— চোখের ভিতরেও দেখবার জিনিস আছে, হৃদয়ের বিচিত্ৰ মায়া । অন্তরে বাহিরে হৃদয়ের রাগরঞ্জিত লীলা নিয়ে পুরুষের জগতে নারীমূর্তিমতী কলালক্ষ্মী হয়ে এল। রস যেখানে রূপ গ্ৰহণ করে সেই কলামূর্তির গুণ হচ্ছে এই যে, তার রূপ তাকে অচল বাধনে বঁধে না । খবরের কাগজের সংবাদ-লেখা প্যারাগ্রাফে ছন্দ নেই, রস নেই, সেই জন্যে সে একেবারে নিরেট, সে যা সে তাই মাত্র। মন তার মধ্যে ছুটি পায় না। ভালো কবিতা যে রূপ গ্ৰহণ কমে সে রূপ নির্দিষ্ট হয়েও অনির্দিষ্ট, পাঠকের স্বাতন্ত্র্যকে সে হাকিয়ে দেয় না । মনে আছে, বহুকাল হল, রোগশয্যায় কালিদাসের কাব্য আগাগোড়া সমস্ত পড়েছিলুম। যে আনন্দ পেলুম সে তো আবৃত্তির আনন্দ নয়, সৃষ্টির আনন্দ । সেই কাব্যে আমার মন আপনি বিশেষ স্বত্ব উপলব্ধি করবার বাধা পেল না। বেশ বুঝলুম, এ-সব কাব্য আমি যেরকম করে পড়লুম দ্বিতীয় আর-কেউ তেমন করে পড়ে নি। মেয়ের মধ্যেও পুরুষের কল্পনা তেমনি করেই আপন মুক্তি পায়। নারীর চারিদিকে যে-পরিমণ্ডল আছে তা অনির্বচনীয়তার ব্যঞ্জনা দিয়ে তৈরি ; পুরুষের কল্পনা সেখানে আপনার রসের রঙ, আপনার ভাবের রূপ মিলিয়ে দিতে কঠিন বাধা পায় না। অর্থাৎ, সেখানে তার নিজের সৃষ্টি চলে, এই জন্যে তার বিশেষ আনন্দ । মোহমুক্ত মানুষ তাই দেখে হাসে ; কিন্তু মোহমুক্ত মানুষের কাছে সৃষ্টি বলে কোনো বালাই নেই, সে প্রলয়ের মধ্যে বাস করে।