পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8(rbr রবীন্দ্র-রচনাবলী আমার পরাভব ঘটছে ; সে-সব বাধা বর্জন করব । পুরুষের চালে তার সমান তালে পা ফেলে তাধ সমান রাস্তায় চলব।” এমন কথা যে একদল স্ত্রীলোকের মুখ দিয়ে বের হল, এটা সম্ভব হল কী করে । এতে বোঝা যায়, পুরুষের প্রকৃতির মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে । মেয়েকে সে চাচ্ছে না । এমন নয় যে সে হঠাৎ সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছে ; ঠিক তার উলটো-সো হয়েছে বিষয়ী ; মেয়েকে সে কডায় গণ্ডায় বুঝে নিতে চায় ; কড়ায় গণ্ডায় যার হিসাব মেলে না। তাকে সে মনে করে বাজে জিনিস, তাকে সে মনে করে ঠকা । সে বলে, “আমি চোখ খুলে সব স্পষ্ট করে তন্ন তন্ন করে দেখব ।” অর্থাৎ ধ্যানের দেখায় যা মনকে ভরিয়ে তোলে সেটাকে সে জানে ফাকি । কিন্তু, পুরুষের সংসারে সত্যকার মেয়ে তো কেবলমাত্ৰ চোখের দেখার নয়, সে তো ধ্যানের জিনিসও বটে । সে যে শরীরী অশরীরী দু’য়ে মিলিয়ে, পৃথিবী যেমন নিজের মাটি ধুলো এবং নিজের চার দিকের অসীম আকাশ ও বায়ুমণ্ডল মিলিয়ে । মেয়ের যা অশরীরী তা যে শরীরী মেয়েকে ঘিরে আছে ; তার ওজন নেই, কিন্তু তার বর্ণ আছে, ভঙ্গী আছে ; তা ঢাকে। অথচ তা প্ৰকাশ করে । পাশ্চাত্য সভ্যতায় যারা উন্নতির বড়াই করে, তারা বলবে, এই মেয়েলির প্রতি অসহিষ্ণুতায় চলার উৎসাহ প্ৰকাশ পায় ; আমার মনে হয়, এটাই থামবার পূর্বলক্ষণ । চলার ছন্দই থাকে না। যদি স্থিতির সঙ্গে তার সমস্ত আপোষ একেবারে মিটে যায় । গাড়িটার ঘোড়াও চলছে, সারথিও চলছে, যাত্রীরাও চলছে, গাড়ির জোড় খুলে গিয়ে তার অংশপ্ৰত্যংশগুলোও চলছে, একে তো চলা বলে না ; এ হচ্ছে মরণোন্মুখ চলার উন্মত্ত প্ৰলাপ, সাংঘাতিক থামার ভূমিকা । মেয়েরা সমাজের চলাকেই স্থিতির ছন্দ দেয়— সে ছন্দ সুন্দর । একদল মেয়ে বলতে শুরু করেছে যে, “ মেয়ে হওয়াতে আমাদের অগো প্লাব, আমাদে, ক্ষতি | অর্থাৎ, আমাদের আত্মপ্রকাশের ধাবায় পুরুষের সঙ্গে প্ৰভেদটাতে পীড়া পাচ্ছি।” এর থেকে বোধ “হচ্ছে, একদিন যে পুরুষ সাধক ছিল এখন সে হয়েছে বণিক । বণিক বাইরের দিকে যদিবা চলে, অস্তরের দিকে আপনার সঞ্চায়ের বোঝার কাছে সতর্ক হয়ে পড়ে আছে । তার স্থিতি সারবান দিগন্তু সুন্দর নয় । তার কারণ, মানুষের সম্বন্ধকে হৃদয়মাধুর্যে সত্য করে পূর্ণ ক’রে তোলা তার স্থিতির ধর্ম নয় ; ধন সঞ্চায়ের তলায় মানুষের সম্বন্ধকে চাপা দিয়ে চ্যাপটা করে দেওয়াই হয়েছে তার কাজ । সুতরাং, সে যে কেবল চলে না তা নয়, আপন স্থিতিকে ভারগ্রস্ত নীরস নির্মম অসুন্দর করে । অঙ্কের কোঠার মধ্যে যাকে ধরে না তাকে সে আবর্জনার মধ্যে ফেলে দেয় । , পুরুষ একদিন ছিল মিস্টিক, ছিল অতল রসের ডুবারি, ছিল ধ্যানী । এখন সে হয়েছে মেয়েদের মতোই সংসারী । কেবল প্ৰভেদ এই যে, তার সংসারে আলো নেই, বাতাস নেই, আকাশ নেই ; বস্তুপিণ্ডে সমস্ত নিরেট । সে ভারি ব্যস্ত । এই ব্যস্ততার মধ্যে সেই আকাশ সে পায় না যে আকাশে আপন কল্পনাকে রূপে রসে মুক্তি দিতে পারে । ج۔ আজকালকার কবি আপন কাব্যে, শিল্পী আপনি কারুতে, অনির্বচনীয়কে সুন্দরকে অবজ্ঞা প্ৰকাশ করতে আরম্ভ করেছে। এটা কি পৌরুষের উলটাে নয় । পুরুষই তো চিরদিন সুন্দরের কাছ থেকে সাধনায়, বাস্তবের আবরণ একটার পর একটা যতই মোচন করেছে ততই রসের লোকে, অধ্যাত্মলোকে সে ভূমার পরিচয় পেয়েছে। আজ কেবলই সে থলির পর থলির মুখ বাধছে, সিন্দুকের পর সিন্দুকে তালা লাগাচ্ছে ; আজ তার সে মুক্তি নেই যে মুক্তির মধ্যে সুন্দর আপনি সিংহাসন রচনা করে । তাই তার মেয়েরা বলছে, “আমরা পুরুষ সাজিব ।” তাই তার কাব্যসরস্বতী বলছে, বীণার তারগুলোকে যত্ন করে না বাধলে যে-সুরাটা ঝনঝন করতে থাকে সেইটেই খাটি বাস্তবের সুর, উপেক্ষার উচ্ছঙ্খল দুরন্তপন্যায় রূপের মধ্যে যে বিপর্যয় যে ছিন্নভিন্নতা ঘটে সেইটেই আর্ট । দিন চলে গেল । ভুলে ছিলুম যে, সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে চলেছি । মন চলেছিল। আপন রাস্তায়, এক ভাবনা থেকে আর-এক ভাবনায় । চলেছিল বললে বেশি বলা হয় । উট যেমন বোঝা পিঠে নিয়ে