পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 N98 রবীন্দ্র-রচনাবলী কালক্রমে আমার ক্ষমতা হ্রাস হয়ে যাচ্ছে, এই বিধিলিপি নিয়ে যুবক হােক, বৃদ্ধ হােক, কবি হােক, অকবি হােক, কার ও সঙ্গে ত্যকরার করার চেয়ে ততক্ষণ একটা গান লেখা ভালো মনে করি, তা সেটা পছন্দসই হােক আর না হােক । এমন-কি, সেই অবসরে ‘শিশু ভোলানাথ-এর জাতের কবিতা যদি লিখতে পারি, তা হলেও মনটা খুশি থাকে । কারণটা কী বলে রাখি । আজ-নাগাদ প্রায় পনেরো-ষোলো বছর ধরে খুব কষে গানই লিখছি। লোকরঞ্জনের জন্যে নয়, কেননা, পাঠকেরা লেখায় ক্ষমতার পরিচয় খোজে । ছোটাে ছোটাে একটু একটু গানে ক্ষমতার কায়দা দেখাবার মতো জায়গাই নেই। কবিত্বকে যদি রীতিমত তাল ঠুকে বেড়াতেই হয় তা হলে অন্তত একটা বড়ো আখড়া চাই । তা ছাড়া গান জিনিসে বেশি বোঝাই সয় না ; যারা মালের ওজন করে দরের যাচাই করে, তারা এরকম দশ-বারো লাইনের হালকা কবিতার বাজার মাড়াতে চায় না। তবু আমি এই কয় বছরে এত গান লিখেছি যে, অন্তত সংখ্যা হিসাবে লম্বা দৌড়ের বাজিতে আমি বোধ হয়। পয়লা নম্বরের পুরস্কার পেতে পারি । , আর-একটা কথা বলে রাখি, গান লিখতে যেমন আমার নিবিড় আনন্দ হয় এমন আর কিছুতে হয় না । এমন নেশায় ধরে যে, তখন গুরুতর কাজের গুরুত্ব একেবারে চলে যায়, বড়ো বড়ো দায়িত্বের ভারাকর্ষণটা হঠাৎ লোপ পায়, কর্তব্যের দাবিগুলোকে মন এক-ধার থেকে নামঞ্জুর করে দেয় । এর কারণ হচ্ছে, বিশ্বকর্মর লীলাখেলার স্রোতটার মধ্যে হঠাৎ পড়ে গেলে শুকনো ডাঙার কথাটা একেবারেই মনে থাকে না । শরতের গাছতলা শিউলি ফুলের অপব্যয়ে ছেয়ে গেল, নিকেশ নেবার কোনো কথাই কেউ বল না । যা হল কেবল তাই দেখেই বলি, যথেষ্ট হয়েছে । ঘোর গরমে ঘাসগুলো শুকিয়ে সব হলদে হয়ে গেল ; বর্ষার প্রথম পসলা বৃষ্টি হয়ে যাবার পরেই হঠাৎ দেখি, ঘাসে অতি ছোটাে ছোটাে বেগনি ফুলে হলদে ফুলে তি । কে দেখে কে না দেখে তার খেয়াল নেই । এটা হল রূপের লীলা, কেবলমাত্র হয়ে ওঠাতেই আনন্দ । এই মেঠো ফুলের একটি মঞ্জরী তুলে ধরে আমি বলি, বাহবা । কেন বলি। ও তো খাবার জিনিস নয়, বেচবার জিনিস নয়, লোহার সিন্দুকে তালা বন্ধ করে রাখবার জিনিস নয়। তবে ওতে আমি কী দেখলুম। যাতে আমার মন বললে “সাবাস” । বস্তু দেখলুম ? বস্তু তো একটা মাটির ঢেলার মধ্যে ওর চেয়ে অনেক বেশি আছে। তবে ? আমি দেখলুম, রূপ । সে কথাটার অর্থ কী ৷ রূপ ছাড়া আর কোনোই অর্থ নেই। রূপ শুধু বলে, “এই দেখো, আমি হয়ে উঠেছি।” যদি আমার মন সায় দিয়ে বলে “তই তো বটে, তুমি হয়েছ, তুমি আছা? আর এই বলেই যদি সে চুপ করে যায়, তা হলেই সে রূপ দেখলে ; হয়ে-ওঠাকেই চরম বলে জানলে । কিন্তু, সজনে ফুল যখন অরূপসমুদ্রে রূপের ঢেউ তুলে দিয়ে বলে, “এই দেখো আমি আছি”, তখন তার কথাটা না বুঝে আমি যদি গোয়ারের মতো বলে বসি “কেন আছ?”- তার মুখ থেকে যদি অত্যন্ত মিথ্যে জবাব আদায় করে নিই, যদি তাকে দিয়ে বলাই “তুমি খাবে বলেই আছি”, তা হলে রূপের চরম রহস্যটা দেখা হল না । একটি ছোট্টো মেয়ে কোথা থেকে আমার যাত্রাপথে জুটে গেছে। তার বয়স আড়াই বছর । তার মধ্যে প্ৰাণের আনন্দ টলমল করে ওঠে, কত মধুর প্রলাপে, কত মন-ভোলানো ভঙ্গিতে ; আমার মন বলে, “মস্ত একটা পাওনা আমি পেলুম।” কী যে পেলুম তাকে হিসাবের অঙ্কে ছকে নেবার জো নেই। আর-কিছু নয়, একটি বিশেষ হয়ে ওঠাকেই আমি চরম করে দেখলুম। ঐ ছোটো মেয়ের হয়ে-ওঠাই আমার পরম লাভ । ও আমার ঘর বঁটি দেয় না, রান্না করে না, তাতে ওর ঐ হয়ে-ওঠার হিসাবটাতে কিছুই কম পড়ছে না । বৈজ্ঞানিক এর হয়তো একটা মোটা কৈফিয়ত দেবে, বলবে, “জীবজগতে বংশরক্ষাটাই সবচেয়ে বড়ো দরকার ; ছোটাে মেয়েকে সুন্দর না লাগলে সেই দরকারটাতে বাধা পড়ে।” মোটা কৈফিয়তটাকে আমি সম্পূর্ণ অগ্ৰাহ্য করি নে, কিন্তু তার উপরেও একটা সূক্ষ্ম তত্ত্ব আছে যার কোনো কৈফিয়ত নেই। একটা ফলের ডালি দেখলে মন খুশি হয়ে ওঠে, আর মাছের ঝোলের পাত্র দেখলে যারা নিরামিষাশী নয়। তাদের মন খুশি হতে পারে ; আহারের প্রয়োজনটা উভয়তই আছে ; সুতরাং খুশির একটা মোটা কৈফিয়ত উভয়তই পাওয়া যায়। তৎসত্ত্বেও ফলের ডালিতে এমন একটি বিশেষ খুশি আছে যা কোনো কৈফিয়ত তলবই করে না । সেইখানে ঐ