পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 \ჟ\ტ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী নিয়ে ফেলে আমার কাছ থেকে কষে কাজ আদায় করে নিচ্ছে । এখানকার সকল কাজই মোটা কৈফিয়তের অপেক্ষা রাখে । খোচা দিয়ে দিয়ে কেবলই জিজ্ঞাসা করে, “ফল হবে কি ” সেইজন্যে যার ফরমাশ কৈফিয়তের সীমানা পেরিয়ে আপন বেদরকারি পাওনা দাবি করে ভিতরে-ভিতরে সে আমাকে কেবলই প্রশ্ন করতে থাকে, “তুমি কবি, চির-ছুটির পরোয়ানা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছ, তার : করলে কী । কাজের ভিড়ের টানাটানিতে পড়ে একেবারেই জাত খুইয়ে বোসো না ।” নিশ্চয় ওরই এই তাগিদেই আমাকে গান লেখায় ; হট্টগোলের মধ্যেও নিজের পরিচয়টা বজায় রাখবার জন্যে, লোকরঞ্জনের জন্যে নয় । কর্তব্য বুদ্ধি তার কীর্তি ফেদে গভীরকণ্ঠে বলে, “পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে গুরুতর ।” তাই আমার ভিতরকার বিধিদত্ত ছুটির খেয়াল বাঁশি বাজিয়ে বলে, “পৃথিবীতে আমিই সবচেয়ে লঘুতম ||” লঘু নয় তো কী ! সেইজন্যে সব জায়াতেই হাওয়ায় হাওয়ায় তার পাখা চলে, তার রঙ-বেরঙের পাখা । ইমারতের মোটা ভিত ফেদে সময়ের সদব্যয় করা তার জাত-ব্যবসা নয় ; সে লক্ষ্মীছাড়া ঘুরে বেড়ায় ফকির পথে, যে পথে রঙের ঝরনা রসের ধারা ঝরে ঝরে দিকে দিকে, ছড়িয়ে পড়ছে বিপুল একটা বাজেখরচের মতো । আমার কেজো পরিচয়টার প্রতি ঈর্ষা করে অবজ্ঞা করে আমার অকেজো পরিচয়টা আমাকে যখন-তখন গান লিখিয়ে লিখিয়ে নিজের দলিল ঠিক করে রাখছে । যখন বিরুদ্ধপক্ষে মাতকাবর সাক্ষী এসে জোটে, তখনই নিজের দাবির দলিল খুব বড়ো করে তুলতে হয় । যতদিন ধরে এক পক্ষে আমার ভারী হয়ে উঠল । এই যে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলছে, এটা আমার অন্তরের খাসি-কামরায় । আমি তার পরে কথাটা এই যে, ঐ ‘শিশু ভোলানাথ-এর কবিতাগুলো খামক কেন লিখতে বসেছিলুম। সেও লোকরঞ্জনের জন্যে নয়, নিতান্ত নিজের গরজে । পূর্বেই বলেছি, কিছুকাল আমেরিকার প্রৌঢ়তার মরুপারে ঘোরতর কার্যপটুতার পাথরের দুর্গে আটকা পড়েছিলুম। সেদিন খুব স্পষ্ট বুঝেছিলুম, জমিয়ে তোলবার মতো এত বড়ো মিথ্যে ব্যাপার জগতে আর কিছুই নেই। এই জমাবার জমাদারটা বিশ্বের চিরাচঞ্চলতাকে বাধা দেবার স্পর্ধা করে ; কিন্তু কিছুই থাকবে না, আজ বাদে কাল সব সাফ হয়ে যাবে। যে স্রোতের ঘূর্ণিপাকে এক-এক জায়গায় এই-সব বস্তুর পিণ্ডগুলোকে স্তৃপাকার করে দিয়ে গেছে সেই স্রোতেরই অবিরত বেগে ঠেলে ঠেলে সমস্ত ভাসিয়ে নীল সমুদ্রে নিয়ে যাবে— পৃথিবীর বক্ষ সুস্থ হবে। পৃথিবীতে সৃষ্টির যে লীলাশক্তি আছে সে যে নির্লোভ, সে নিরাসক্ত, সে অকৃপণ ; সে কিছু জমতে দেয় না, কেননা, জমার জঞ্জালে তার সৃষ্টির পথ আটকায় ; সে যে নিত্যনূতনের নিরস্তর প্রকাশের জন্যে তার অবকাশকে নির্মল করে রেখে দিতে চায় । লোভী মানুষ কোথা থেকে জঞ্জাল জড়ো করে সেইগুলোকে আগলে রাখবার জন্যে নিগড়বদ্ধ লক্ষ লক্ষ দাসকে দিয়ে প্রকাণ্ড সব ভাণ্ডার তৈরি করে তুলছে। সেই ধ্বংসশাপগ্ৰস্ত ভাণ্ডারের কারাগারে জড়বস্তুপুঞ্জের অন্ধকারে বাসা বেঁধে সঞ্চয়গর্বের ঔদ্ধত্যে মহাকালকে কৃপণটা বিদ্রুপ করছে ; এ বিদ্রুপ মহাকাল কখনোই সইবে না। আকাশের উপর দিয়ে যেমন ধুলানিবিড় আঁধি ক্ষণকালের জন্যে সূর্যকে পরাভূত করে দিয়ে তার পরে নিজের দীেরাত্ম্যের কোনো চিহ্ন না রেখে চলে যায়, এ-সব তেমনি করেই শূন্যের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিছুকালের জন্যে আমি এই বস্তু-উদগারের অন্ধ্যযন্ত্রের মুখে এই বস্তুসঞ্চায়ের অন্ধভাণ্ডারে বদ্ধ হয়ে আতিথ্যহীন সন্দেহের বিষবাম্পে শ্বাসরুদ্ধপ্ৰায় অবস্থায় কাটিয়েছিলুম। তখন আমি এই ঘন দেয়ালের বাইরের রাস্তা থেকে চিরপথিকের পায়ে শব্দ শুনতে পেতুম । সেই শব্দের ছন্দই যে আমার রক্তের মধ্যে বাজে, আমার ধ্যানের মধ্যে ধ্বনিত হয় । আমি সেদিন স্পষ্ট বুঝেছিলুম, আমি ঐ পথিকের সহচর । আমেরিকার বস্তুগ্রিাস থেকে বেরিয়ে এসেই “শিশু ভোলানাথ লিখতে বসেছিলুম। বন্দী যেমন ফাক পেলেই ছুটে আসে সমুদ্রের ধারে হাওয়া খেতে, তেমনি করে। দেয়ালের মধ্যে কিছুকাল সম্পূর্ণ