পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

3. 9. о রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী যখন ছোটাে ছিলেম, মনে পড়ে, বিশ্বজগৎ আমার কাছে প্রতিদিন অন্ধকার রাত্রির গর্ভ থেকে নূতন দেহ ধরে জন্ম নিত । পরিচয় আর অপরিচয় আমার মনের মধ্যে এক হয়ে মিলেছিল । আর সেই শিশুকাল পথিকের কাল । তখন পথের শেষের দিকে লক্ষ্য খুঁজি নি, পথের আশেপাশে চেয়ে চেয়ে চলছি, যেন কোন আবছায়ার ভিতর থেকে আচমকা দেখা দেবে একটা “কী জানি”, একটা “হয়তো” । বারান্দার কোণে খানিকটা ধুলো জড়ো করে আতার বিচি পুতে রোজ জল দিয়েছি। আজ যেটা আছে বীজ কাল সেটা হবে গাছ, ছেলেবেলায় সে একটা মস্ত “কী জানি”র দলে ছিল। সেই কী-জানিকে দেখাই সত্য দেখা । সত্যের দিকে চেয়ে যে বলে “জানি” সেও তাকে হারায়, যে বলে “জানি নে” সেও করে ভুল, আমাদের ঋষিরা এই বলেন । যে বলে “খুব জানি” সেই অবোধ সোনা ফেলে চাদরের গ্ৰন্থিকে পাওয়া মনে করে, যে বলে “কিছুই জানি নে” সে তো চাদরটাকে সুদ্ধ খুইয়ে বসে । আমি ঈশোপনিষদের এই মানেই বুঝি । “জানি না” যখন “জানি”র আঁচলে গাঠছিড়া বেঁধে দেখা দেয়। তখন মন বলে, “ধন্য হলেম ।” পেয়েছি মনে করার মতো হারানো আর নেই । খ এইজন্যেই ভারতবর্ষকে ইংরেজ যেমন করে হারিয়েছে এমন আর য়ুরোপের কোনো জাত নয় । ভারতবর্ষের মধ্যে যে একটা চিরকেলে রহস্য আছে সেটা তার কাছ থেকে সরে গেল । তার ফৌজের গীঠের মধ্যে যে বস্তুটাকে কষে বাধতে পারলে সেইটােকেই সে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ বলে বুক ফুলিয়ে গদীয়ান হয়ে বসে রইল । ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তার বিস্ময় নেই, অবজ্ঞা যথেষ্ট আছে । রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বাইরে ইংরেজি ভারত সম্বন্ধে যত অল্প আলোচনা করেছে এমন ফ্রান্স করে নি, জমনি করে নি । পোলিটিশনের চশমার বাইরে ভারতবর্ষ ইংরেজিজাতির গোচরে আছে, এ কথাটা তার দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিক কাগজ পড়ে দেখলে বোঝা যায় না । এর একমাত্র কারণ, ভারতবর্ষে ইংরেজের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি । প্রয়োজন-সাধনের দেখা নিছক পাওয়ারই দেখা, তার মধ্যে না-পাওয়ার আমেজ নেই । এইজন্যেই একে সত্যের দেখা বলা যায় না । এই দেখায় সত্য নেই বলেই তাতে বিস্ময় নেই, শ্রদ্ধা নেই । প্ৰয়োজনের সম্বন্ধ হচ্ছে কেবলই গ্রহণের সম্বন্ধ ; তাতে লোভ আছে, আনন্দ নেই । সত্যের সম্বন্ধ হচ্ছে পাওয়া এবং দেওয়ার মিলিত সম্বন্ধ ; কেননা, আনন্দই মন খুলে দিতে জানে । এই কারণেই দেখতে পাই, ভারতবর্ষের প্রতি ইংরেজের ব্যক্তিগত বদ্যান্যতার অদ্ভুত অভাব। এ কথা নিয়ে নালিশ করা বৃথা, এইটেই স্বাভাবিক । ইংরেজের লোভ যে ভারতবর্ষকে পেয়েছে ইংরেজের আত্মা সেই ভারতবর্ষকে হারিয়েছে। এই জন্যেই ভারতবর্ষে ইংরেজের লাভ, ভারতবর্ষে ইংরেজের গর্ব, ভারতবর্ষে ইংরেজের ক্লেশ । এইজন্যে ভারতবর্ষকে স্বাস্থ্য দেওয়া, শিক্ষা দেওয়া, মুক্তি দেওয়া সম্বন্ধে ইংরেজের ত্যাগ দুঃসাধ্য কিন্তু শাস্তি দেওয়া সম্বন্ধে ইংরেজের ক্ৰোধ অত্যন্ত সহজ । ইংরেজ-ধনী বাংলাদেশের রক্ত-নেংড়ানো পাটের বাজারে শতকরা চার-পাচশো টাকা মুনাফা শুষে নিয়েও যে দেশের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে এক পয়সাও ফিরিয়ে দেয় না, তার দুর্ভিক্ষে বন্যায় মারী-মাড়কে যার কড়ে আঙুলের প্রান্তও বিচলিত হয় না, যখন সেই শিক্ষাহীন স্বাস্থ্যহীন উপবাসক্লিষ্ট বাংলাদেশের বুকের উপর পুলিসের জাত বসিয়ে রক্তচক্ষু কর্তৃপক্ষ কড়া আইন পাস করেন তখন সেই বিলাসী ধনী স্ফীত মুনফার উপর আরামের আসন পেতে বাহবা দিতে থাকে ; বলে, “এই তো পাকা চালে ভারতশাসন ৷” এইটেই স্বাভাবিক। কেননা, ঐ ধনী বাংলাদেশকে একেবারেই দেখতে পায় নি, তার মোটা মুনফার ওপারে বাংলাদেশ আড়ালে পড়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রাণের নিকেতনে যেখানে ক্ষুধাতৃষ্ণার কান্না, বাংলাদেশের হৃদয়ের মাঝখানে যেখানে তার সুখ-দুঃখের বাসা, সেখানে মানুষের প্রতি মানুষের মৈত্রীর একটা বড়ো রাস্তা আছে, সেখানে ধর্মবুদ্ধির বড়ো দাবি বিষয়বুদ্ধির গরজের চেয়ে বেশি, এ কথা