পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 ASR রবীন্দ্র-রচনাবলী অসাড়তা । আমাদের চৈতন্যের আলো স্নান করে দিয়ে সে সত্যকে আবৃত করে । সে বিঘ্ন নয়, সে আবরণ । অভ্যাস অনেক সময় সেই মোহরূপে আমাদের মনকে আবিষ্ট করে । কুয়াশায় পৃথিবীর বস্তুকে নষ্ট করে না, তার আকাশকে লুপ্ত করে । অসীমকে অগোচর করে দেয়। অভ্যাসের মোহ মনের সেই কুয়াশা । অনির্বচনীয়কে সে আড়াল করে, বিস্ময়ারসকে সে শুকিয়ে ফেলে । তাতে সত্য পদার্থের গুরুত্ব কমে না, তার গৌরব কমে যায় । আমাদের মন তখন সত্যের অভ্যর্থনা করতে পারে না । বিস্ময় হচ্ছে সত্যের অভ্যর্থনা । ডাক্তার বলে, প্রতিদিন একই অভ্যস্ত খাওয়া পরিপাকের পক্ষে অনুকুল নয়। ভোজ্য সম্বন্ধে রসনার বিস্ময় না থাকলে দেহ তাকে গ্রহণ করতে আলস্য করে । শিশু-ছাত্রদের একই ক্লাসে একই সময়ে একই বিষয় শিক্ষার পুনরাবৃত্তি করানোতেই তাদের শিক্ষার আগ্রহ ঘুচিয়ে দেওয়া হয় । প্রাণের স্বভাবই চির-উৎসুক। প্রকৃতি তাকে ক্ষণে ক্ষণে আকস্মিকের স্পর্শে চঞ্চল করে রাখে। এমন-কি, এই আকস্মিক যদি দুঃখ আকারেও আসে তাতেও চিত্তের বড়ো রকমের উদবোধন ঘটে । সীমার অতীত যা, আকস্মিক হচ্ছে তারই দূত ; অভাবনীয়ের বার্তা নিয়ে সে আসে, চেতনাকে জড়ত্ব থেকে মুক্তি দেয় । আমাদের দেশে তীর্থযাত্রা ধর্মসাধনার একটি প্রধান অঙ্গ। দেবতাকে যখন অভ্যাসের পর্দায় ঘিরে রাখে তখন আমরা সেই পর্দাকেই পূজা করি । যাদের মন স্বভাবতই বিষয়ী, ধৰ্মচৰ্চাতেও যারা বস্তুকে বেশি দাম দেয়, তারা দেবতার চেয়ে পর্দাকেই বেশি শ্রদ্ধা করে । তীর্থযাত্রায় সেই পর্দা ঠেলে দিয়ে মন পথে বেরিয়ে পড়ে । তখন প্ৰতিদিনের সীমাবদ্ধ জানাকে চিরদিনের অসীম অজানার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা সহজ হয় । প্রতিদিন ও চিরদিনের সংগমস্থলেই সত্যের মন্দির । এবারে তাই পথের দুই পাশে চাইতে চাইতে বেরিয়েছিলুম। অভ্যাসের জগতে যাকে দেখেও দেখি নে, মন জেগে উঠে বললে, সেই চির-অপরিচিত হয়তো কোথায় অজানা ফুলের মালা পরে অজানা তারার রাত্রে দেখা দেবে । অভ্যাস বলে ওঠে, “সে নেই গো নেই, সে মরীচিকা ।” গণ্ডীর বাইরেকার বিশ্ব বলে, “আছে বৈকি, তাকিয়ে দেখো । দেখা হয়ে চুকেছে মনে করে দেখা বন্ধ কর, তাই তো দেখা হয় না ।” তখন ক্ষণে ক্ষণে মনে হয়, “দেখা হল বুঝি।” পথিকের প্রাণের উদবোধন সেই কী-জানি । সেই কী-জানির উদ্দেশে গান লিখেছি । জীবনের সকল নৈরাশ্য, সকল বিড়ম্বনা, সকল তুচ্ছতার অবসাদ অতিক্রম করেও সেই কী-জানির আভাস আলোতে-ছায়াতে ঝলমল করে উঠছে, পথিক তারই চমক নেবার জন্যে তার জানা ঘরের কোণ ফেলে পথে বেরিয়েছে । ক্রাকোভিয়া জাহাজ v ১১ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ বৈষ্ণবী আমাকে বলেছিল, “কার বাড়িতে বৈরাগীর কখন অন্ন জোটে তার ঠিকানা নেই ; সে-অন্নে নিজের জোর দাবি খাটে না, তাই তো বুঝি। এ অন্ন। তিনিই জুগিয়ে দিলেন।” এই কথাই কাল বলেছিলেম, বাধা পাওয়ায় পাওয়ার সত্য মান হয়ে যায় । না-পাওয়ার রসটা তাকে ঘিরে থাকে না । ভোগের মধ্যে কেবলমাত্রই পাওয়া, পশুর পাওয়া ; আর সম্ভোগের মধ্যে পাওয়া না-পাওয়া দুই-ই মিলেছে, সে হল মানুষের । ছেলেবেলা হতেই বিদ্যার পাকা বাসা থেকে বিধাতা আমাকে পথে বের করে দিয়েছেন । অকিঞ্চন বৈরাগীর মতো অস্তরের রাস্তায় একা চলতে চলতে মনের অন্ন যখন-তখন হঠাৎ পেয়েছি । আপন-মনে কেবলই কথা বলে গেছি, সেই হল লক্ষ্মীছাড়ার চাল। বলতে বলতে এমন কিছু শুনতে পাওয়া যায় যা পূর্বে শুনি নি। বলার স্রোতে যখন জোয়ার আসে তখন কোন গুহার ভিতরকার