পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8 AA সকলেই জানে, এই শক্তিরই বিকারের মতো এমন সর্বনেশে বিপদ আর কিছুই নেই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীমের হৃদয়ের মধ্যে অদৃশ্য থেকে দ্ৰৌপদী তাকে বল জুগিয়েছেন। বীর আন্টনির হৃদয় অধিকার করে ক্লিওপাট্রা তার বলা হরণ করে নিল । সত্যবানকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করেন সাবিত্রী, কিন্তু কত নারী পুরুষের সত্য নষ্ট করে তাকে মৃত্যুর মুখে নিয়ে গেছে তার সংখ্যা নেই। তাই তো গোড়ায় বলেছি, প্রেমের দুই বিরুদ্ধ পার আছে। এক পারে চোরাবালি, আর-এক পারে ফসলের খেত। এক পারে ভালোলাগার দৌরাত্ম্য, অন্য পারে ভালোবাসার আমন্ত্রণ । মাতৃস্নেহের মধ্যেও এই দুই জাতের প্ৰেম । একটাতে প্রধানত আসক্তি নিজের পরিতৃপ্তি খোজে ; সেই অন্ধ মাতৃস্নেহ আমাদের দেশে বিস্তর দেখতে পাই । তাতে সস্তানকে বড়ো করে না তুলে তাকে অভিভূত করে । তাতে কোনো পক্ষেরই কল্যাণ নেই। যে-প্ৰেম ত্যাগের দ্বারা মানুষকে মুক্তি দিতে জানে না। পরন্তু ত্যাগের বিনিময়ে মানুষকে আত্মসাৎ করতে চায় সে-প্ৰেম তো রিপু । এক পক্ষকে ক্ষুধার দাহে সে দগ্ধ করে, অন্য পক্ষকে লালায়িত আসক্তি দ্বারা লেহন করে জীৰ্ণ করে দেয় । এই মাতুলালনপাশের পরিবেষ্টনের মধ্যে যারা চির-অবরুদ্ধ আমাদের দেশে তাদের সংখ্যা বিস্তর ; তাদের শৈশব আর ছাড়তে চায় না। আসক্তি-পরায়ণ মাতার মুঢ় আদেশপালনের অনৰ্থ বহন করে অপমানের মধ্যে অভাবের মধ্যে চিরজীবনের মতো মাথা হেঁট হয়ে গেছে, এমন-সকল বয়স্ক নাবালকের দল আমাদের দেশে ঘরে ঘরে । আমাদের দেশে মাতার ক্রোড়রাজত্ববিস্তারে পৌরুষের যত হানি হয়েছে। এমন বিদেশি শাসনের হাতকড়ির নির্মমতার দ্বারাও হয় নি । স্ত্রীপুরুষের প্রোমেও সেই একই কথা । নারীর প্ৰেম পুরুষকে পূর্ণশক্তিতে জাগ্রত করতে পারে ; কিন্তু সে-প্রেম যদি শুক্লপক্ষের না হয়ে কৃষ্ণপক্ষের হয় তবে তার মালিন্যের আর তুলনা নেই। পুরুষের সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ তপস্যায় ; নারীর প্রেমে ত্যাগধর্ম সেবাধর্ম সেই তপস্যারই সুরে সুর-মেলানাে ; এই দুয়ের যোগে পরস্পরের দীপ্তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নারীর প্রেমে আর-এক সুরও বাজতে পারে, মদনধনুর জ্যায়ের টঙ্কার- সে মুক্তির সুর না, সে বন্ধনের সংগীত । তাতে তপস্যা ভাঙে, শিবের ক্রোধানল উদ্দীপ্ত হয় । , , কেন বলি, পুরুষের ধর্ম তপস্যা । কারণ, জীবলোকের কাজে প্রকৃতি তাকে নারীর তুলনায় অনেক পরিমাণে অবকাশ দিয়েছে। সেই অবকাশটাকে নষ্ট করলেই তার সবচেয়ে ফাকি । পুরুষ সেই অবকাশকে আপনি সাধনার ক্ষেত্র করেছে বলেই মানুষের উৎকর্ষ জৈব প্রকৃতির সীমানা অনেক দূরে ছাড়িয়ে গেল। প্রকৃতির দাবি থেকে মুক্তি নিয়েই পুরুষ জ্ঞানকে ধ্যানকে শক্তিকে অসীমের মধ্যে অনুসরণ করে চলছে। সেইজন্যে পুরুষের সাধনায় চিরকালই প্রকৃতির সঙ্গে বিরুদ্ধতা আছে। নারীর : প্রেম যেখানে এই বিরোধের সমন্বয় করে দেয়, কঠোর জ্ঞানের বেদিপ্রাঙ্গণে সে যখন পূজামাধুর্যের আসন রচনা করে- পুরুষের মুক্তিকে যখন সে লুপ্ত করে না, তাকে সুন্দর করে তোলে- তার পথকে অবরুদ্ধ করে না, পথের পাথেয় জুগিয়ে দেয়- ভোগবতীর জলে ডুবিয়ে দেয় না, সুরধুনীর জলে স্নান করায়- তখন বৈরাগ্যের সঙ্গে অনুরাগের, হরের সঙ্গে পার্বতীর, শুভপরিণয় সার্থক হয় । বিচ্ছেদের ভিতর দিয়েই শক্তি কাজ করবার ক্ষেত্ৰ পায় । চাদ ও পৃথিবীর মাঝখানে যে-বিরহ আছে তারই অবকাশে পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রকে চাদ কথা কওয়ায় । স্ত্রীপুরুষের পরস্পরের মাঝে বিধাতা একটি দূরত্ব রেখে দিয়েছেন । এই দূরত্বের ফাকটাই কেবলই সেবায় ক্ষমায় বীর্যে সৌন্দর্যে কল্যাণে ভরে ওঠে ; এইখানেই সীমায় অসীমে শুভদৃষ্টি । জৈবক্ষেত্রে প্রকৃতির অধিকারের মধ্যে মানুষের অনেক সৃষ্টি আছে, কিন্তু চিত্তক্ষেত্রে তার সৃষ্টির অন্ত নেই। চিত্তের মহাকাশ স্কুল আসক্তির দ্বারা জমাট হয়ে না গেলে তবেই সেই সৃষ্টির কাজ সহজ হয়। দীপশিখাকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে যে-মাতাল বেশি করে পেতে চায়, সে নিজেও পোড়ে, আলোটিকেও নিবিয়ে দেয় । মুক্ত অবকাশের মধ্যে পুরুষ মুক্তিসাধনার যে-মন্দির বহুদিনের তপস্যায় গেঁথে তুলেছে পূজারিনী নারী সেইখানে প্রেমের প্রদীপ জ্বালবার ভার পেল। সে-কথা যদি সে ভুলে যায়, দেবতার নৈবেদ্যকে যদি সে মাংসের হাটে বেচাতে কুষ্ঠিত না হয়, তা হলে মর্তের মর্মস্থানে যে-অমরাবতী আছে তার