পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী Sb করবার অবকাশ ও অধিকার হারায় নি । এইজন্যেই আকবরের মতো সম্রাটের আবির্ভাব তখন সম্ভবপর হয়েছিল, এইজন্যেই যখন ভ্ৰাতৃরক্তপঙ্কিল পথে আওরংজেব গোড়ামির কঠোর শাসন বিস্তার করেছিলেন তখন তারই ভাই দারাশিকো সংস্কারবর্জিত অসাম্প্রদায়িক সত্যসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন । তখন বড়ো দুঃখের দিনেও মানুষের পথ ছিল সহজ । আজ সে-পথ বড়ো দুৰ্গম । এখনকার দিনে প্রবীণের পথের প্রত্যেক কাকর গুনে বাধারই হিসাবকে প্রকাণ্ড করে তোলে ; মৃত্যুঞ্জয় মানবাত্মার অপরাহত শক্তিকে তারা উপস্থিতের ছোটো ছোটো বিরুদ্ধসাক্ষ্যের জোরে অবজ্ঞা করে । তাই, তারা এত কৃপণ, এত সন্দিগ্ধ, এত নিষ্ঠুর, এত আত্মম্ভরি । বিশ্বাস যার নেই সে কখনো সৃষ্টি করতে পারে না, সে কেবলই সংগ্ৰহ করতে পারে ; অবশেষে এই সংগ্ৰহ নিয়েই যত মারামারি কাটাকাটি । আজকের এই বিশ্বাসহীন আনন্দইন অন্ধযুগ, কবির বাণীকে প্রার্থনা করছে এই কথা শোনাবার জন্যে যে, আত্মম্ভরিতায় বন্ধন, আত্মপ্রকাশেই মুক্তি ; আত্মম্ভরিতায় জড় বস্তুরাশির জটিলতা, আত্মপ্রকাশে বিরলভূষণ সত্যের সরল রূপ । হারুনা-মারু জাহাজ থেকে নেমে প্যারিসে কয়েক দিন মাত্র ভূমিমাতার শুশ্রুষা ভোগ করতে পেরেছিলাম । হঠাৎ খবর এল, যথাসময়ে পেরুতে পৌছতে হলে অবিলম্বে জাহাজ ধরা চাই । তাড়াতাড়ি শেরবুরাগ-বন্দর থেকে আন্ডেস জাহাজে উঠে পড়লুম। লম্বায় চওড়ায় জাহাজটা খুব মস্ত কিন্তু আমার শরীরের বর্তমান অবস্থায় আরামের পক্ষে যে-সব সুবিধার প্রয়োজন ছিল, তা পাওয়া গেল না। জাপানি জাহাজে আতিথ্যের প্রচুর দাক্ষিণ্যে আমার অভ্যাসটাও কিছু খারাপ করে দিয়েছিল। সেইজন্যে এখানে ক্যাবিনে প্রবেশ করেই মনটা অপ্ৰসন্ন হল। কিন্তু, যেটা অনিবাৰ্য নিজের গরজেই মন তার সঙ্গে যত শীঘ্ৰ পারে রফা করে নিতে চায়। অত্যন্ত দুষ্পাচ্য জিনিসও পেটে পড়লে পাকযন্ত্র হাল ছেড়ে দিয়ে জার্যকরস প্রয়োগ বন্ধ করে না । মনেরও জারকরস আছে ; অনভ্যস্ত কোনো দুঃখকে হজম করে নিয়ে তাকে সে আপনার অভ্যস্ত বিশ্বের শামিল করে নিশ্চিন্ত হতে চায় । অসুবিধাগুলো । একরকম সহ্য হয়ে এল, আর দিনের-পর-দিন চরকার একঘেয়ে সুতো কাটার মতো একটানে চলতে ळ्ळन । বিষুবরেখা পার হয়ে চলেছি, এমন সময় হঠাৎ কখন শরীর গেল বিগড়ে ; বিছানা ছাড়া গতি রইল না। ক্যাবিন জিনিসটাই একটা স্থায়ী ব্যাধি, ইন্দ্ৰিয়গুলো যদি তার সঙ্গে যোগ দিয়ে জুলুম শুরু করে তা হলে পুলিসের আকস্মিক বন্ধনের বিরুদ্ধে আদালতে পর্যন্ত আপিল বন্ধ হয়, কোথাও কিছুই সাস্তুনা থাকে না । শান্তিহীন দিন আর নিদ্রাহীন রােত আমাকে পিঠামোড়া করে শিকল কাষতে লাগল। বিদ্রোহের চেষ্টা করতে গেলে শাসনের পরিমাণ বাড়তেই থাকে। রোগ-গারদের দারোগা আমার বুকের উপর দুর্বলতার বিষম একটা বোঝা চাপিয়ে রেখে দিলে ; মাঝে মাঝে মনে হত, এটা স্বয়ং যমরাজের পায়ের চাপ । দুঃখের অত্যাচার যখন অতিমাত্রায় চড়ে ওঠে তখন তাকে পরাভূত করতে পারি। নে ; কিন্তু, তাকে অবজ্ঞা করবার অধিকার তো কেউ কাড়তে পারে না- আমার হাতে তার একটা উপায় আছে, সে হচ্ছে কবিতা-লেখা । তার বিষয়টা যা-ই হােক-না কেন, লেখাটাই দুঃখের বিরুদ্ধে সিডিশন-বিশেষ। সিডিশনের দ্বারা প্রতাপশালীর বিশেষ অনিষ্ট হয় না, তাতে পীড়িত চিত্তের আমি সেই কাজে লাগলুম, বিছানায় পড়ে পড়ে কবিতা লেখা চলল। ব্যাধিটা-যে ঠিক কী তা নিশ্চিত বলতে পারি নে, কেবল এই জানি, সে একটা অনির্বচনীয় পীড়া । সে-পীড়া শুধু আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নয়, ক্যাবিনের সমস্ত আসবাবপত্রের মধ্যে সর্বত্র সঞ্চারিত- আমি আর আমার ক্যাবিন । সমস্তটা মিলে যেন একটা অখণ্ড রুগণতা। এমুনতরো অসুখের সময় স্বভাবতই দেশের জন্যে ব্যাকুলতা জন্মে। ক্যাবিনের জঠরের মধ্যে দিবারাত্রি জীর্ণ হতে হতে আমারও মন ভারতবর্ষের আকাশের উদ্দেশে উৎসুক হয়ে উঠল। কিন্তু, অন্ধ