পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8 ܠ ܬ জাহাজ ক্রিাকোভিয়া । ৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ মানুষের মধ্যে মন প্ৰাণ দেহ এই তিনে মিলে কাজ চালায়, এই তিনের আপসে আমাদের কর্মবেগের একটা ছন্দ তৈরি করে । শীতের দেশে দেহ সহজেই ছুটে চলতে চায় ; তারই সঙ্গে তাল রাখবার জন্যে মনেরও তাড়াতাড়ি ভাবা দরকার । গরম দেশে আমরা ধীরে সুস্থে চলি, ধীরে সুস্থে ভাবি, কোনো বিষয়ে মন স্থির করতে বিলম্ব ঘটে । শীতের দেশে যে-তেজকে দেহের মধ্যেই জাগিয়ে তুলতে হয় গরম দেশে সেই তেজ দেহের বাইরে ; সেই আকাশব্যাপী তেজ শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ; সেইজন্যে আভ্যন্তরিক উত্তেজনা যাতে বেড়ে না। ওঠে আমাদের শরীরের সেই অভিপ্ৰায় । চলাফেরার দম সর্বদাই তাকে কমিয়ে রাখতে হয়, তাই আমাদের মনের মধ্যে কর্মচিন্তার छ्ना मान्नाद्धकाएछ । মনের ভাবনা ও হুকুমের অপেক্ষায় যখন দেহকে কাজ চালাবার জন্যে পথ চেয়ে থাকতে হয় না। তখন তাকেই বলে অভ্যাস, সেই অভ্যাসেই নৈপুণ্য । কর্মের তাল যতই দ্রুত হয়, দেহের পক্ষে ততই দ্বিধাবিহীন হওয়া দরকার । ভাবতে মনের যে-সময় লাগে তার জন্যে সবুর করতে গেলেই দ্বিধা ঘটে । বাহিরে কর্মের ফল সেই সবুরের জন্যে যদি অপেক্ষা করতে না পারে তা হলেই বিভ্ৰাট । মোটরগাড়ির একটা বিশেষ বেগ আছে, কখন তার হাল বায়ে ফেরাব, কখন ডাইনে, তা ঠিক করতে হলে সেই কলের বেগের দ্রুত ছন্দেই ঠিক করতে হয়, নইলে বিপদ ঘটে । সেই দ্রুততা বার বার অভ্যাসের জোরেই সহজ হয় । অভ্যাসের বাহিরে কোনো নূতন অবস্থা এসে পড়লে অপঘাত ঘটায়, অর্থাৎ যেখানে মনের দরকার সেখানে মনকে প্ৰস্তুত না পেলেই মুশকিল । দাম দিয়ে কলের তাল দুন চৌদুন করা শক্ত নয়, সেই সঙ্গে অভ্যাসের বেগও অনেক পরিমাণে বাড়ানো চলে। কিন্তু এই দ্রুত অভ্যাসের নৈপুণ্যে সেই-সব কাজই সম্ভবপর হয় যা “বস্তুগত । অর্থাৎ, এক ব্লস্তা বঁধবার জায়গায় দুই বস্তা বাধা যায় । কিন্তু, যা কিছু প্ৰাণগত ভাবগত তা কলের ছন্দের অনুবতী হতে চায় না । যারা পালোয়ান প্রকৃতির লোক সংগীতে তারা দুন চৌদুনের বেগ দেখে পুলকিত হয়ে ওঠে ; কিন্তু পদ্মবনের তরঙ্গদোলায় যারা বীণাপাণির মাধুর্যে মুগ্ধ, ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে তার মোটরযাত্রার প্ৰস্তাবে তাদের মনে হয়-হায় করতে থাকে । পশ্চিম মহাদেশে মানুষের জীবনযাত্রার তাল কেবলই দুন থেকে চৌদুনের অভিমুখে চলেছে । কেননা, জীবনের সার্থকতার চেয়ে বস্তুর প্রয়োজন অত্যন্ত বেড়ে উঠেছে। ঘর ভেঙে হাট তৈরি হল, রব উঠল : Time is Money । এই বেগের পরিমাপ সহজ । সেইজন্যে সেখানে একটা জিনিস সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে, যেটা সকলেরই কাছে সুস্পষ্ট, যেটা বুঝতে কারও মুহুর্তকাল দেরি হয় না, সে হচ্ছে পাখোয়াজির হাত দুটাের দুড় দাড় তাণ্ডবনৃত্য । গান বুঝতে যে সবুর করা অত্যাবশ্যক, সেটা সম্পূর্ণ বাদ দিয়েও রক্ত গরম হয়ে ওঠে, ভিড়ের লোকে বলে, “সাবাস ! এ একটা কাণ্ড বটে !” এবার জাহাজে সিনেমা অভিনয় দেখা আমার ভাগ্যে ঘটেছিল । দেখলুম, তার প্রধান জিনিসটাই হচ্ছে দ্রুত লয় । ঘটনার দ্রুততা বারে বারে চমক লাগিয়ে দিচ্ছে । এই সিনেমা আজকালকার দিনে সর্বসাধারণের একটা প্ৰকাণ্ড নেশা । ছেলে বুড়ো সকলকেই প্রতিদিন এতে মাতিয়ে রেখেছে। তার মানে হচ্ছে সকল বিভাগেই বর্তমান যুগে কলার চেয়ে কারদানি বড়ো হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনসাধনের মুগ্ধদৃষ্টি কারদানিকেই পছন্দ করে । সিদ্ধি, ইংরেজিতে যাকে সাকসেস বলে, তার প্রধান বাহন হচ্ছে দ্রুত নৈপুণ্য । পাপকর্মের মধ্য দিয়েও সেই নৈপুণ্যের লীলাদৃশ্য আজ সকলের কাছে উপাদেয় । সুষমাকে কল্যাণাকে উপলব্ধি করবার মতো শান্তি ও অবকাশ প্রতিদিন প্ৰতিহত হতে চলল ; সিদ্ধির ঘোড়দৌড়ে জুয়োখেলার উত্তেজনা পশ্চিমদিগন্তে কেবলই ঘূর্ণি হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে। পশ্চিমমহাদেশের অন্ধকার পটের উপর আবর্তমান পলিটিক্সের দৃশ্যটাকে একটা সিনেমার বিপুলাকার চলচ্ছবির মতো দেখতে হয়েছে। ব্যাপারটা হচ্ছে, দ্রুতলয়ের প্রতিযোগিতা। জলে স্থলে ܓܣ{|ܘ ܠ