পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8&G পথে কঠিন বাধা । খাচার মধ্যে পাখিকে বাধা খোরাক খাওয়ানো যায়, কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ পাখি হতে শেখানো যায় না। বনের পাখি ওড়ার সঙ্গে খাওয়ার মিল করে আনন্দিত হয়। প্রকৃতির অভিপ্ৰায় ছিল চলার সঙ্গে পাওয়ার মিল করে মানুষকে শেখানো । কিন্তু, হতভাগ্য মানবসন্তানের পক্ষে চলা বন্ধ করে দিয়ে শেখানেই শিক্ষাপ্রণালী বলে গণ্য হয়েছে। তাতে কত ব্যর্থতা, কত দুঃখ তার হিসেব কে রাখে । আমি তো পথ-চলা শিক্ষাব্যবস্থার কথা অনেকবার প্রস্তাব করেছি, কিন্তু কারও মন পাই নে । কারণ, যারা ভদ্রশিক্ষা পেয়েছে তারা বাধনের শিক্ষাকেই বিশ্বাস করতে শিখেছে । আমার ভাগ্য আমাকে শিক্ষায় বিবাগী করেছে বলেই খোলা পথের শিক্ষার ধারাকেই আমি সব চেয়ে সম্মান দিই । শিশু যে-জগতে সঞ্চারণ করে তার প্রায় সমস্তই সে প্ৰবল করে দেখে । জীবনে নানা অবান্তর বিষয় জমে উঠে তার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে নি। যখন আমি শিশু ছিলুম। তখন আমাদের ছাদের উপর গিয়ে গয়লাপাড়ার দৃশ্য প্রতিদিনই দেখেছি ; প্রতিদিনই তা সম্পূর্ণ চােখে পড়েছে, প্রতিদিনই তা ছবি ছিল। আমার দৃষ্টি আর আমার দৃষ্টির বিষয়ের মাঝখানে কোনো ভাবনা, অভ্যাসের কোনো জীৰ্ণতা আড়াল করে নি। আজ সেই গোয়ালপাড়া কতকটা তেমনি করে দেখতে হলে সুইজার্ল্যান্ডে যেতে হয়। সেখানে মন ভালো করে স্বীকার করে, হঁহা, আছে । vr শিশুর কাছে বিশ্ব খুব করে আছে, আমরা বয়স্কেরা সে কথা ভুলে যাই । এইজন্যে, শিশুকে কোনো ডিসিপ্লিনের ছাচে ঢালবার জন্যে যখন তাকে জগৎ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের নিজের বানানো কলের মধ্যে বন্ধ করি তখন তাকে যে কতখানি বঞ্চিত করি তা নিজের অভ্যাসদোষেই বুঝতে পারি নে। বিশ্বের প্রতি তার এই একান্ত স্বাভাবিক ঔৎসুক্যের ভিতর দিয়েই যে তাকে শিক্ষা দিতে হবে, নিতান্ত গোয়ারের মতো সে কথা আমরা মানি নে । তার ঔৎসুক্যের আলো নিবিয়ে তার মনটা অন্ধকার করে দিয়ে শিক্ষার জন্যে তাকে এডুকেশন-জেলখানার দারোগার হাতে সমর্পণ করে দেওয়াই আমরা পস্থা বলে জেনেছি। বিশ্বের সঙ্গে মানুষের মনের যে স্বাভাবিক সম্বন্ধ এই উপায়ে সেটাকে কঠোর শাসনে শিশুকাল থেকেই নষ্ট ও বিকৃত করে দিই।-- ছবি বলতে আমি কী বুঝি সেই কথাটাই আর্টিস্টকে খোলসা করে বলতে চাই । মোহের কুয়াশায়, অভ্যাসের আবরণে, সমস্ত মন দিয়ে জগৎটাকে “আছে” বলে অভ্যর্থনা করে নেবার আমরা না পাই অবকাশ, না পাই শক্তি । সেইজন্য জীবনের অধিকাংশ সময়ই আমরা নিখিলকে পাশ কাটিয়েই চলেছি। সত্তার বিশুদ্ধ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েই মারা গেলুম। ছবি, পাশ কাটিয়ে যেতে আমাদের নিষেধ করে । যদি সে জোর গলায় বলতে পারে “চেয়ে দেখো”, তা হলেই মন স্বপ্ন থেকে সত্যের মধ্যে জেগে ওঠে । কেননা, যা আছে তাই সৎ ; যেখানেই সমস্ত মন দিয়ে তাকে অনুভব করি সেখানেই সত্যের স্পর্শ পাই । কেউ না ভেবে বসেন, যা চোখে ধরা পড়ে। তাই সত্য। সত্যের ব্যাপ্তি অতীতে ভবিষ্যতে, দৃশ্যে অদৃশ্যে, বাহিরে অন্তরে। আর্টিস্ট সত্যের সেই পূর্ণতা যে পরিমাণে সামনে ধরতে পারে “আছে” বলে মনের সায় সেই পরিমাণে প্রবল, সেই পরিমাণে স্থায়ী হয় ; তাতে আমাদের ঔৎসুক্য সেই পরিমাণে অক্লাস্ত, আনন্দ সেই পরিমাণে গভীর হয়ে ওঠে । । আসল কথা, সত্যকে উপলব্ধির পূর্ণতার সঙ্গে সঙ্গে একটা অনুভূতি আছে, সেই oት আমরা সুন্দরের অনুভূতি বলি। গোলাপফুলকে সুন্দর বলি এইজন্যেই যে, গোলাপ ফুলের দিকে আমার মন যেমন করে চেয়ে দেখে ইটের ঢেলার দিকে তেমন করে চায় না। গােলাপফুল আমার