পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী (շ O Գ \) বুনো হাতি মূর্তিমান উৎপাত, বজবুংহিত ঝড়ের মেঘের মতো। এতটুকু মানুষ, হাতির একটা পায়ের সঙ্গেও যার তুলনা হয় না, সে. ওকে দেখে খামখা বলে উঠল, “আমি এর পিঠে চড়ে বেড়াব৷ ” এই প্ৰকাণ্ড দুর্দাম প্ৰাণপিণ্ডটাকে গা গা করে শুড় তুলে আসতে দেখেও এমন অসম্ভবপ্রায় কথা কোনো একজন ক্ষীণকায় মানুষ কোনো এককালে ভাবতেও পেরেছে, এইটেই আশ্চর্য। তার পরে “পিঠে চড়ব” বলা থেকে আরম্ভ করে পিঠে চড়ে-বসা পর্যন্ত যে-ইতিহাস সেটাও অতি অদ্ভুত। অনেকদিন পর্যন্তই সেই অসম্ভবের চেহারা সম্ভবের কাছ দিয়েও আসে নি- পরম্পরাক্রমে কত বিফলতা কত অপঘাত মানুষের সংকল্পকে বিদ্রুপ করেছে তার সংখ্যা নেই ; সেটা গণনা করে করে মানুষ বলতে পারত, এটা হবার নয় । কিন্তু তা বলে নি । অবশেষে একদিন সে হাতির মতো জন্তুরও পিঠে চড়ে ফসলখেতের ধারে লোকালয়ের রাস্তায়-ঘাটে ঘুরে বেড়ালো। এটা সাংঘাতিক অধ্যবসায়, সেইজন্যেই গণেশের হাতির মুণ্ডে মানুষের সিদ্ধির মূর্তি। এই সিদ্ধির দুই দিকে দুই জন্তুর চেহারা, এক দিকে রহস্যসন্ধানকারী সূক্ষ্মঘাণ তীক্ষদৃষ্টি খরদন্ত চঞ্চল কৌতুহল, সেটা ইদুর, সেইটেই বাহন ; আর-একদিকে বন্ধনে বশীভূত বন্যাশক্তি যা দুৰ্গমের উপর দিয়ে বাধা ডিঙিয়ে চলে, সেই হল যান— সিদ্ধির যানবাহনযোগে মানুষ কেবলই এগিয়ে চলছে। তার ল্যাবরেটরিতে ছিল ইদুর, আর তার এরোপ্লেনের মোটরে আছে হাতি । ইদুরটা চুপিচুপি সন্ধান বাতলিয়ে দেয়, কিন্তু ঐ হাতিটাকে কায়দা করে নিতে মানুষের অনেক দুঃখ ৷ তা হােক, মানুষ দুঃখকে দেখে হার মানে না, তাই সে আজ দ্যুলোকের রাস্তায় যাত্রা আরম্ভ করলে । কালিদাস রাঘবদের কথায় বলেছেন, তাবা আনাকরথবির্ভুনাম'- স্বৰ্গ পর্যন্ত তাদের রথের রাস্তা । যখন এ কথা কবি বলেছেন তখন মাটির মানুষের মাথায় এই অদ্ভুত চিন্তা ছিল যে, আকাশে না চললে মানুষের সার্থকতা নেই। সেই চিন্তা ক্রমে আজ রূপ ধরে বাইরের আকাশে পাখা ছড়িয়ে দিলে। কিন্তু, রূপ যে ধরল। সে মৃত্যুজয়কারী ভীষণ তপস্যায় । মানুষের বিজ্ঞানবুদ্ধি সন্ধান করতে জানে, এই যথেষ্ট নয় ; মানুষের কীর্তিবুদ্ধি সাহস করতে জানে, এইটে তার সঙ্গে যখন মিলেছে তখনই সাধকদের তপঃসিদ্ধির পথে পথে ইন্দ্ৰদেব যে-সব বাধা রেখে দেন সেগুলো ধূলিসাৎ হয় । তীরে দাড়িয়ে মানুষ সামনে দেখলে সমুদ্র । এত বড়ো বাধা কল্পনা করাই যায় না । চোখে দেখতে পায় না। এর পর, তলিয়ে পায় না। এর তল।। যমের মোষের মতো কালো, দিগন্তপ্রসারিত বিরাট একটা নিষেধ কেবলই তরঙ্গতর্জনী তুলছে। চিরবিদ্রোহী মানুষ বললে, “নিষেধ মানব না।” বজ্রগর্জনে জবাব এল, “না মান তো মরবে।” মানুষ তার এতটুকুমাত্র বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ তুলে বললে, “মরি তো মরব !” এই হল জাত-বিদ্রোহীদের উপযুক্ত কথা । জাত-বিদ্রোহীরাই চিরদিন জিতে এসেছে। একেবারে গোড়া থেকেই প্রকৃতির শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষ নানা ভাবেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিলে। আজ পর্যন্ত তাই চলছে। মানুষের মধ্যে যারা যত খাটি বিদ্রোহী, যারা বাহ্য শাসনের সীমা-গণ্ডি যতই মানতে চায় না, তাদের অধিকার ততই বেড়ে চলতে থাকে । যেদিন সাড়ে তিনহাত মানুষ স্পর্ধা করে বললে “এই সমুদ্রের পিঠে চড়ব” সেদিন দেবতারা হাসলেন না ; তঁরা এই বিদ্রোহীর কানে জয়মন্ত্র পড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করে রইলেন। সমুদ্রের পিঠ আজ আয়ত্ত হয়েছে, সমুদ্রে তলাটাকেও কায়দা করা শুরু হল। সাধনার পথে ভয় বার বার ব্যঙ্গ করে উঠছে ; বিদ্রোহীর অন্তরের মধ্যে উত্তরসাধক অবিচলিত বসে প্রহরে প্রহরে হাক দিচ্ছে, “মাভৈঃ ।” কালকের চিঠিতে ক্ৰন্দসীর কথা বলেছি, অন্তরীক্ষে উচ্ছসিত হয়ে উঠছে সত্তার ক্ৰন্দন গ্রহে শিক্ষত্রে । এই সত্তা বিদ্রোহী, অসীম অব্যক্তের সঙ্গে তার নিরন্তর লড়াই। বিরাট অপ্রকাশের তুলনায় সে অতি সামান্য, কিন্তু অন্ধকারের অন্তহীন পারাবারের উপর দিয়ে ছোটাে ছোটো কোটি কোটি আলোর তরী সে ভাসিয়ে দিয়েছে- দেশকালের বুক চিরে অতলস্পর্শের উপর দিয়ে তার অভিযান । কিছু ভুবছে, কিছু ভাসছে, তবু যাত্রার শেষ নেই। ა O|[\ტტ