পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

cov রবীন্দ্র-রচনাবলী প্ৰাণ তার বিদ্রোহের ধ্বজা নিয়ে পৃথিবীতে অতি দুর্বলরাপে একদিন দেখা দিয়েছিল । অতি প্ৰকাণ্ড অতি কঠিন, অতি গুরুভার অপ্ৰাণ চারি দিকে গদা উদ্যত করে দাড়িয়ে, আপনি ধুলোর কয়েদখানায় তাকে দ্বার জানলা বন্ধ করে প্রচণ্ড শাসনে রাখতে চায়। কিন্তু, বিদ্রোহী প্ৰাণ কিছুতেই দমে না ; দেয়ালে দেয়ালে কত জায়গায় কত ফুটােই করছে তার সংখ্যা নেই, কেবলই আলোর পথ নানা দিক দিয়েই খুলে দিচ্ছে। সত্তার এই বিদ্রোহমান্ত্রের সাধনায় মানুষ যতদূর এগিয়েছে এমন আর-কোনো জীব না । মানুষের মধ্যে যার বিদ্রোহশক্তি যত প্ৰবল, যত দুৰ্দমনীয়, ইতিহাসকে ততই সে যুগ হতে যুগান্তরে অধিকার করছে, শুধু সত্তার ব্যাপ্তি দ্বারা নয়, সত্তার ঐশ্বর্য দ্বারা । এই বিদ্রোহের সাধনা দুঃখের সাধনা ; দুঃখই হচ্ছে হাতি, দুঃখই হচ্ছে সমুদ্র । বীর্যের দাপো এর পিঠে যারা চড়ল। তারাই বঁাচল ; ভয়ে অভিভূত হয়ে এর তলায় যাবা পড়েছে তারা মরেছে। আর, যারা একে এড়িয়ে শাস্তায় ফল লাভ করতে চায় তারা নকল ফলের ছদ্মবেশে ফকির বোঝার ভারে মাথা হেঁট করে বেড়ায় । আমাদের ঘরের কাছে সেই জাতের মানুষ অনেক দেখা যায় । বীরত্বের হাকডাক করতে তারা শিখেছে, কিন্তু সেটা যথাসম্ভব নিরাপদে করতে চায় । যখন মার আসে তখন নালিশ করে বলে, বড়ো লাগছে। এরা পৌরুষের পরীক্ষাশালায় বসে বিলিতি বই থেকে তার বুলি চুরি করে, কিন্তু কাগজের পরীক্ষা থেকে যখন হাতের পরীক্ষার সময় আসে তখন প্রতিপক্ষের অনীেদার্য নিয়ে মামলা তুলে বলে, “ওদের স্বভাব ভালো নয়, ওরা বাধা দেয় ।” মানুষকে নারায়ণ সখা বলে তখনই সম্মান করেছেন যখন তাকে দেখিয়েছেন তার উগ্ররূপ, তাকে দিয়ে যখন বলিয়েছেন : দৃষ্টাদ্ভুতংরূপমুগ্ৰং তবেদং লোকত্ৰয়ং প্রব্যথিতঃ মহাত্মন— মানুষ যখন প্ৰাণমন দিয়ে স্তব করতে পেরেছে : অনন্তবীর্যামিতবিক্রমন্তঃ সৰ্ব্বং সমাগ্লোষি ততোহসি সর্বঃ । তুমিই অনন্তবীর্য, তুমিই অমিতবিক্রম, তুমিই সমস্তকে গ্ৰহণ করো, তুমিই সমস্ত ইতি ৩রা are Soos 8 কাল সকালেই পৌঁছব সিঙ্গাপুরে । তার পর থেকে আমার ডাঙার পালা । এই-যে চলছে আমার মনে মনে বকুনি, এটাতে খুবই বাধা হবে । অবকাশের অভাব হবে বলে নয়, মন এই কদিন যে-কক্ষে চলছিল সে-কক্ষ থেকে ভ্ৰষ্ট হবে বলে । কিসের জন্যে । সর্বসাধারণ বলে যে একটি মনুষ্যসমষ্টি আছে তারই আকর্ষণে । লেখবার সময় তার কোনো আকর্ষণ যে একটুও মনের মধ্যে থাকবে না, তা হতেই পারে না | কিন্তু, তার নিকটের আকর্ষণটা লেখার পক্ষে বড়ো ব্যাঘাত । কাছে যখন সে থাকে তখন সে কেবলই ঠেলা দিয়ে দিয়ে দাবি করতে থাকে । দাবি করে তারই নিজের মনের কথাটাকে ৷ প্ৰকাণ্ড একটা বাইরের ফরমাশ কলামটাকে ভিতরে ভিতরে টান মারে । বলতে চাই বটে। “তোমাকে গ্রাহ্য করি নৌ", কিন্তু হেঁকে উঠে বলার মধ্যেই গ্রাহ্য করাটা প্ৰমাণ হয় । আসল কথা সাহিত্যের শ্রোতৃসভায় আজ সর্বসাধারণই রাজাসনে । এ সত্যটাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে লিখতে বসা অসম্ভব । প্রশ্ন উঠতে পারে উড়িয়ে দেবেই বা কেন । এমন সময় কবে ছিল যখন সাহিত্য সমস্ত মানবসাধারণের জন্যেই ছিল না । ১ নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখিত ।