পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(* O রবীন্দ্র-রচনাবলী যেন আপন রচনাকে কৃতাৰ্থ মনে না করি, যেন আমাদের এই কথা মনে করবার সাহস থাকে যে, সাহিত্যের গণনাতত্ত্বে এক অনেক সময়েই হাজারের চেয়ে সংখ্যায় বেশি হয়ে থাকে । এইবার আমার জাহাজের চিঠি তার অন্তিম পঙক্তির দিকে হেলে পড়ল। বিদায় নেবার পূর্বে তোমার কাছে মাপ চাওয়া দরকার মনে করছি। তার কারণ, চিঠি লিখব বলে বসলুম। কিন্তু কোনোমতেই চিঠি লেখা হয়ে উঠল না । এর থেকে আশঙ্কা হচ্ছে, আমার চিঠি লেখবার বয়স পেরিয়ে গেছে । প্রতিদিনের স্রোতের থেকে প্ৰতি দিনের ভেসে-আসা কথা ছেটে তোলবার শক্তি এখন আমার নেই । চলতে চলতে চার দিকের পরিচয় দিয়ে যাওয়া এখন আমার দ্বারা আর সহজে হয় না । অথচ, এক সময়ে এ শক্তি আমার ছিল । তখন অনেককে অনেক চিঠিই লিখেছি । সেই চিঠিগুলি ছিল চলতি কালের সিনেমা ছবি । তখন ছিল মনের পটটা বাইরের সমস্ত আলোছায়ার দিকে মেলে দেওয়া । সেই-সব ছাপের ধারায় চলত চিঠি । এখন বুঝিবা বাইরের ছবির ফোটােগ্রাফটা বন্ধ হয়ে গিয়ে মনের ধ্বনির ফেনোগ্রাফটাই সজাগ হয়ে উঠেছে । এখন হয়তো দেখি কম, শুনি বেশি । মানুষ তো কোনো-একটা জায়গায় খাড়া হয়ে দাড়িয়ে নেই । এইজন্যেই চলচ্চিত্র ছাড়া তার যথার্থ চিত্র হতেই পারে না । প্রবহমান ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে চলমান আপনার পরিচয় মানুষ দিতে থাকে । যারা আপনলোক, নিয়ত তারা সেই পরিচয়টা পেতে ইচ্ছে করে । বিদেশে নূতন নূতন ধাবমান অবস্থা ও ঘটনার চঞ্চল ভূমিকার উপরে প্রকাশিত আত্মীয়-লোকের ধারাবাহিক পরিচয়ের ইচ্ছা স্বাভাবিক । চিঠি সেই ইচ্ছা পূরণ করবার জন্যেই । কিন্তু, সকলপ্রকার রচনাই স্বাভাবিক শক্তির অপেক্ষা করে । চিঠি-রচনাও তাই । আমাদের দলের মধ্যে আছেন সুনীতি । আমি তাকে নিছক পণ্ডিত বলেই জানতুম । অর্থাৎ আস্ত জিনিসকে টুকরো করা ও টুকরো জিনিসকে জোড়া দেওয়ার কাজেই তিনি হাত পাকিয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস ছিল । কিন্তু এবার দেখলুম, বিশ্ব বলতে যে-ছবির স্রোতকে বোঝায়, যা ভিড় করে ছোটে এবং এক মুহুর্ত স্থির থাকে না, তাকে তিনি তালভঙ্গ না করে মনের মধ্যে দ্রুত এবং সম্পূৰ্ণ ধরতে পারেন। আর কাগজে-কলমে সেটা দ্রুত এবং সম্পূর্ণ তুলে নিতে পারেন । এই শক্তির মূলে আছে বিশ্বব্যাপারের প্রতি তার মনের সজীব আগ্ৰহ । তার নিজের কাছে তুচ্ছ বলে কিছুই নেই, তাই তার কলমে তুচ্ছও এমন একটি স্থান পায় যাতে তাকে উপেক্ষা করা যায় না । সাধারণত, এ কথা বলা চলে যে শব্দতত্ত্বের মধ্যে যারা তলিয়ে গেছে শব্দচিত্র তাদের এলেকার সম্পূৰ্ণ বাইরে, কেননা চিত্রটা একেবারে উপরের তলায় । কিন্তু, সুনীতির মনে সুগভীর তত্ত্ব ভাসমান চিত্রকে ডুবিয়ে মারে নি এই বড়ো অপূর্ব । সুনীতির নীরন্ধ চিঠিগুলি তোমরা যথাসময়ে পড়তে পাবে- দেখবে এগুলো একেবার বাদশাই চিঠি । এতে চিঠির ইম্পিরিয়ালিজম ; বর্ণনাসাম্রাজ্য সর্বগ্রাহী, ছোটাে বড়ো কিছুই তার থেকে বাদ পড়ে নি । সুনীতিকে উপাধি দেওয়া উচিত, লিপিবাচস্পতি কিংবা লিপিসার্বভৌম কিংবা লিপিচক্রবতী । ইতি ৩রা শ্রাবণ ১৩৩৪ । নাগপঞ্চমী ।* G সামনে সমুদ্রের অর্ধচন্দ্রাকার তটসীমা । অনেক দূর পর্যন্ত জল অগভীর, জলের রঙে মাটির আভাস, সে যেন ধরণীর গেরুয়া আঁচল এলিয়ে পড়েছে । ঢেউ নেই, সমস্তদিন জলরাশি এগোয় আর পিছোয় অতি ধীর গমনে । অন্সর আসছে। চুপি চুপি পিছন থেকে পৃথিবীর চোখ টিপে ধরবে বলে— সোনার রেখায় রেখায় কৌতুকের মূচকে-হাসি । সামনে বঁা-দিকে একদল নারকেলগছ, সুদীর্ঘ গুড়ির উপর সিধে হয়ে দাড়াতে পারে নি, পরস্পরের দিকে তাদের হেলাহেলি । নিত্যদোলায়িত শাখায় শাখায় সূর্যের আলো ওরা ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে, محسی ১ নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখিত ।