পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী . ○ > > চঞ্চল ছেলেরা যেমন নদীর ঘাটে জল-ছোড়াছড়ি করে । সকালের আকাশে ওদের এই অবগাহনমান । এটা একজন চীনীয় ধনীর বাড়ি । আমরা তার অতিথি । প্রশস্ত বারান্দায় বেতের কেদারায় বসে আছি। সমুদ্রের দিক থেকে বুক ভরে বইছে পশ্চিমে হাওয়া। চেয়ে দেখছি, আকাশের কোণে কোণে দলভাঙা মেঘগুলি শ্রাবণের কালো উদি ছেড়ে ফেলেছে, এখন কিছুদিনের জন্যে সূর্যের আলোর সঙ্গে ওদের সন্ধি । আমার অস্পষ্ট ভাবনাগুলোর উপর ঝরে পড়ছে কম্পমান নারকেলপাতার ঝরঝর শব্দের বৃষ্টি, বালির উপর দিয়ে ভাটার সমুদ্রের পিছু-হাটার শব্দ ওরই সঙ্গে একই মৃদুস্বরে মেলানাে । । ওদিকে পাশের ঘরে ধীরেন এসরাজ নিয়ে আপন মনে বাজিয়ে চলেছে- ভৈরো থেকে রামকেলি, । রামকেলি থেকে ভৈরবী ; আস্তে আস্তে অকেজো মেঘের মতো খেয়ালের হাওয়ায় বদল হচ্ছে রাগিণীর আকৃতি । - আজ সকালে মনটা যেন ভাটার সমুদ্র, তীরের দিক টানছে তাকে কোন দিকে তার ঠিকানা নেই । আপনাকে আপনি সর্বাঙ্গে সর্বাস্তঃকরণে ভরপুর মেলে দিয়ে বসে আছি, নিবিড় তরুপল্লবের শ্যামলতায় আবিষ্ট রোদ-পোয়ানো ঐ ছোটো দ্বীপটির মতো । আমার মধ্যে এই ঘনীভূত অনুভবটিকে বলা যেতে পারে হওয়ার আনন্দ । রূপে রঙে আলোয় ধ্বনিতে আকাশে অবকাশে ভরে-ওঠা একটি মূর্তিমান সমগ্ৰতা আমার চিত্তের উপরে ঘা দিয়ে বলছে “আছি” ; তারই জগতে আমার চৈতন্য উছলে উঠছে ; সমুদ্রকল্লোলেরই মতো একতান শব্দ জাগছে, ওম, অর্থাৎ এই-যে আমি । বিরাট একটা “না”, হঁহা-করা তার মুখগহবর, প্ৰকাণ্ড তার শূন্য- তারই সামনে ঐ নারকেলগাছ দাডিয়ে, পাতা নেড়ে নেড়ে বলছে, এই-যে আমি । দুঃসাহসিক সত্তার এই স্পর্ধা গভীর বিস্ময়ে বাজছে আমার মনে, আর ধীরেন। ঐ-যে ভৈরবীতে মীড়, লাগিয়েছে সেও যেন বিশ্বসত্তার আত্মঘোষণা, আপনি কম্পমান সুরের ধ্বজাটিকে অসীম শূন্যের মাঝখানে তুলে ধরেছে। এই তো হল “হওয়া” । এইখানেই শেষ নেই। এর সঙ্গে আছে করা । সমুদ্র আছে অস্তরে অস্তরে নিস্তব্ধ, কিন্তু তার উপরে উপরে উঠছে ঢেউ, চলছে জোয়ার ভাটা । জীবনে করার বিরাম নেই । এই করার দিকে কত প্ৰয়াস, কত উপকরণ, কত আবর্জনা । এরা সব জমে জমে কেবলই গণ্ডী হয়ে ওঠে, . দেয়াল হয়ে দাড়ায় । এরা বাহিরে সমগ্রতার ক্ষেত্ৰকে, অস্তরে পরিপূর্ণতার উপলব্ধিকে, টুকরো টুকরো করতে থাকে । অহমিকার উত্তেজনায় কর্ম উদ্ধত হয়ে, একান্ত হয়ে, আপনাকে সকলের আগে ঠেলে তোলে ; হওয়ার চেয়ে করা বড়ো হয়ে উঠতে চায় । এতে ক্লাস্তি, এতে অশান্তি, এতে মিথ্যা । বিশ্বকর্মর বাঁশিতে নিয়তই যে ছুটির সুর বাজে এই কারণেই সেটা শুনতে পাই নে ; সেই ছুটির সুরেই বিশ্বকাজের ছন্দ বাধা । সেই সুরটি আজ সকালের আলোতে ঐ নারকেলগাছের তানপুরায় বাজছে । ওখানে দেখতে পাচ্ছি, শক্তির রূপ আর মুক্তির রূপ অনবচ্ছিন্ন এক । এতেই শান্তি, এতেই সৌন্দৰ্য । জীবনের মধ্যে এই মিলনটিই তো খুঁজি- করার চিরবহমান নদীধারায় আর হওয়ার চিরগভীর মহাসমুদ্রে মিলন । এই আত্মপরিতৃপ্ত মিলনটিকে লক্ষ্য করেই গীতা বলেছেন, “কর্ম করো, ফল চেয়ে না৷ ” এই চাওয়ার রাহুটাই কর্মের পাত্র থেকে তার অমৃত ঢেলে নেবার জন্যে লালায়িত । ভিতরকার সহজ হওয়াটি সার্থক হয়। বাইরেকার সহজ কর্মে । অস্তরের সেই সার্থকতার চেয়ে বাইরের স্বার্থ প্রবল হয়ে উঠলেই কর্ম হয় বন্ধন ; সেই বন্ধনেই জডিত যত হিংসা দ্বেষ ঈর্ষা, নিজেকে ও অন্যকে প্ৰবঞ্চনা । এই কর্মের দুঃখ, কর্মের অগৌরব, যখন অসহ্য হয়ে ওঠে তখন মানুষ বলে বসে “দূর হােক গে, কর্ম ছেড়ে দিয়ে চলে যাই ।” তখন আবার আহবান আসে, কর্ম ছেড়ে দিয়ে কর্ম থেকে নিষ্কৃতি নেই ; করাতেই হওয়ার ভূপ্রকাশ। বাহা হলের ঘর নয় আপন অন্তর্নিহিত সত্যের থাকাই কর্মসার্থক হােক, তাতেই হােক ফল-চাওয়া কর্মের নাম চাকরি, সেই চাকরির মনিব আমি নিজেই হই বা অন্যেই হােক । চাকরিতে মাইনের জন্যই কাজ, কাজের জন্যে কাজ নয় । কাজ তার নিজের ভিতর থেকে নিজে যখন কিছুই রস জোগায় না, সম্পূর্ণ বাইরে থেকেই যখন আপন দাম নেয়, তখনই মানুষকে সে অপমান করে । ।