পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী . G. S G অতিথিদের অন্নদান করেছিলেন । ভারতবর্ষে একটা দ্বন্দ্ব ছিল অরণ্যের সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রের, আর-একটা দ্বন্দ্ৰ বেদের ধর্মের সঙ্গে কৃষ্ণের ধর্মের । লঙ্কা ছিল অনাৰ্যশক্তির পুরী, সেইখানে আর্যের হল জয় ; কুরুক্ষেত্র ছিল কৃষ্ণবিরোধী কৌরবের ক্ষেত্র, সেইখানে কৃষ্ণভক্ত পাণ্ডব জয়ী হলেন । সব ইতিহাসেই বাইরের দিকে অন্ন নিয়ে যুদ্ধ, আর ভিতরের দিকে তত্ত্ব নিয়ে-যুদ্ধ । প্ৰজা বেড়ে যায়, তখন খাদ্য নিয়ে স্থান নিয়ে টানাটানি পড়ে, তখন নব নব ক্ষেত্রে কৃষিকে প্রসারিত করতে হয় । চিত্তের প্রসার বেড়ে যায়, তখন যারা সংকীর্ণ প্ৰথাকে আঁকড়ে থাকে তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ৰ বাধে যারা সত্যকে প্রশস্ত ও গভীর ভাবে গ্ৰহণ করতে চায় । এক সময়ে ভারতবর্ষে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ প্ৰবল হয়েছিল ; এক পক্ষ বেদমন্ত্রকেই ব্ৰহ্ম বলতেন, অন্য পক্ষ ব্ৰহ্মকে পরমাত্মা বলে জেনেছিলেন । বুদ্ধদেব যখন তার ধর্মপ্রচার শুরু করেন তার পূর্বেই ব্ৰাহ্মণে ক্ষত্রিয়ে মতেব দ্বন্দ্ব তার পথ অনেকটা পরিষ্কার ‘করে দিয়েছে । রামায়ণ-মহাভারতের মধ্যে ভারতবর্ষের যে মূল ইতিহাস নানা কাহিনীতে বিজড়িত, তাকে স্পষ্টতর করে দেখতে পাব যখন এখানকার পাঠগুলি মিলিয়ে দেখবার সুযোগ হবে । কথায় কথায় এখানকার একজনের কাছে শোনা গেল যে, দ্রোণাচার্য ভীমকে কৌশলে বধ করবার জন্যে কোনো-এক অসাধ্য কর্মে পাঠিয়েছিলেন । দ্রুপদ-বিদ্বেষী দ্ৰোণ যে পাণ্ডবদের অনুকুল ছিলেন না, তার হয়তো প্ৰমাণ এখানকার মহাভারতে আছে । - রামায়ণের কাহিনী সম্বন্ধে আর-একটি কথা আমার মনে আসছে, সেটা এখানে বলে রাখি । কৃষির ক্ষেত্র দুরকম করে নষ্ট হতে পারে—— এক বাইরের দৌরাত্ম্যে, আর-এক নিজের অযত্নে । যখন রাবণ সীতাকে কেড়ে নিয়ে গেল তখন রামের সঙ্গে সীতার আবার মিলন হতে “ পেরেছিল । কিন্তু, যখন অযত্নে অনাদরে রামসীতার বিচ্ছেদ ঘটল। তখন পৃথিবীর কন্যা সীতা পৃথিবীতেই মিলিয়ে গেলেন । অযত্নে নির্বাসিত সীতার গর্ভে যে-যমজ সন্তান জন্মেছিল তাদের নাম লব কুশ । লবের মূল ধাতুগত অর্থ ছেদন, কুশের অর্থ জানাই আছে। কুশ ঘাস একবার জন্মালে ফসলের খেতকে-যে কিরকম নষ্ট করে সেও জানা কথা । আমি যো-মানেটা আন্দাজ করছি সেটা যদি একেবারেই অগ্রাহ্য না হয় তা হলে লবের সঙ্গে কুশের একত্র জন্মানোর ঠিক তৎপর্য কী হতে পারে, এ কথা আমি পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করি । অন্যদের চিঠি থেকে খবর পেয়ে থাকবে যে, এখানে আমরা প্ৰকাণ্ড একটা অস্ত্যেষ্টিসৎকারের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছি । মোটের উপরে এটা কতকটা চীনেদের মতো— তারাও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এইরকম ধুমধাম সাজসজ্জা বাজনাবাদ্য করে থাকে । কেবল মস্ত্ৰোচ্চারণ প্রভৃতির ভঙ্গিটা হিন্দুদের মতো । দাহ ক্রিয়াটা এরা হিন্দুদের কাছ থেকে নিয়েছে । কিন্তু, কেমন মনে হয়, ওটা যেন অস্তরের সঙ্গে নেয় নি । হিন্দুরা আত্মাকে দেহের অতীত করে দেখতে চায়, তাই মৃত্যুর পরেই পুড়িয়ে ফেলে দেহের মমতা থেকে একেবারে মুক্তি পাবার চেষ্টা করে । এখানে মৃতদেহকে অনেক সময়েই বহু বৎসর ধরে রেখে দেয় । এই রেখে দেবার ইচ্ছেটা কবর দেবার ইচ্ছেরই সামিল । এদের রীতির মধ্যে এরা দেহটাকে রেখে দেওয়া আর দেহটাকে পোড়ানো, এই দুই উলটো প্রথার মধ্যে যেন রফানিস্পত্তি করে নিয়েছে। মানুষের মনঃপ্রকৃতির বিভিন্নতা স্বীকার করে নিয়ে হিন্দুধর্ম রফানিস্পত্তিসূত্ৰে কত বিপরীত রকম রাজিনামা লিখে দিয়েছে তার ঠিকানা নেই । ভেদ নষ্ট করে ফেলে হিন্দুধর্ম ঐক্যস্থাপনের চেষ্টা করে নি, ভেদ রক্ষা করেও সে একটা ঐক্য আনতে চেয়েছে । কিন্তু, এমন ঐক্য সহজ নয় বলেই এর মধ্যে দৃঢ় ঐক্যের শক্তি থাকে না । বিভিন্ন বহুকে এক বলে স্বীকার করেও তার মাঝে মাঝে অলঙ্ঘনীয় দেয়াল তুলে দিতে হয় । একে অবিচ্ছিন্ন এক বলা যায় না, একে বলতে হয় বিভক্ত এক । ঐক্য এতে ভারগ্রস্ত হয়, ঐক্য এতে শক্তিমান হয় না । আমাদের দেশের স্বধর্মানুরাগী অনেকেই বালিদ্বীপের অধিবাসীদের আপনি বলে স্বীকার করে নিতে উৎসুক হবেন, কিন্তু সেই মুহুর্তেই নিজের সমাজ থেকে ওদের দূরে ঠেকিয়ে রাখবেন । এইখানে প্রতিযোগিতায় মুসলমানের সঙ্গে আমাদের হারাতেই হয় । মুসলমানে মুসলমানে এক মুহুর্তেই সম্পূৰ্ণ জোড় লেগে