পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gł br রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী কাল শত শত অতীত শতাব্দী জুড়ে এক হয়ে আছে। এখানে কালসংক্ষেপ করবার কোনো দরকার নেই। এখানে যা-কিছু আছে তা চিরদিনের ; যেমন একালের তেমনি সেকালের । ঋতুগুলি যেমন চলেছে নানা রঙের ফুল ফোটাতে ফোটাতে, নানা রসের ফল ফলাতে ফলাতে, এখানকার মানুষ বংশপরম্পরায় তেমনি চলেছে নানা রূপে বর্ণে গীতে নৃত্যে অনুষ্ঠানের ধারা বহন করে । রেলগাড়ি এখানে নেই। কিন্তু আধুনিক কালের ভবঘুরে যারা এখানে আসে তাদের জন্যে আছে মোটরগাড়ি । অতি অল্পকালের মধ্যেই তাদের দেখাশুনো ভোগ-করা শেষ করা চাই । তারা আঁট-কালের মানুষ এসে পড়েছে অপর্যাপ্ত-কালের দেশে । এখানকার অরণ্য পর্বত লোকালয়ের মাঝখান দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলেছি আর কেবলই মনে হচ্ছে, এখানে পায়ে হেঁটে চলা উচিত । যেখানে পথের দুই ধারে ইমারত সেখানে মোটরের সঙ্গে সঙ্গে দুই চক্ষুকে দৌড় করালে খুব বেশি লোকসান হয় না ; কিন্তু পথের দুধারে যেখানে রূপের মেলা সেখানকার নিমন্ত্রণ সারতে গেলে গরজের মোটরটাকে গারাজেই রেখে আসতে হয় । মনে নেই কি, শিকার করতে দুষ্যস্ত যখন রথ ছুটিয়েছিলেন তখন তার বেগ কত ; এই হচ্ছে যাকে বলে প্রোগ্রেস, লক্ষ্যভেদ করবার জন্যে তাড়াহুড়ো । কিন্তু, তপোবনের সামনে এসে তাকে রথ ফেলে নামতে হল, লক্ষ্যসাধনের লোভে নয়, তৃপ্তিসাধনের আশায় । সিদ্ধির পথে চলা দৌড়ে, সুন্দরের পথে চলা ধীরে । আধুনিক ; কালে সিদ্ধির লোভ প্ৰকাণ্ড, প্ৰবল ; তাই আধুনিক কালের বাহনের বেগ কেবলই বেড়ে যাচ্ছে । যা-কিছু গভীরভাবে নেবার যোগ্য, দৃষ্টি তাকে গ্ৰহণ না করে স্পর্শ করেই চলে যায়। এখন হ্যামলেটের অভিনয় অসম্ভব হল, হ্যামলেটের সিনেমার হল জিত । আমাদের মোটর যেখানে এসে থামল সেখানে এক বিপুল উৎসব । জায়গাটার নাম বাংলি । কোনো-এক রাজবংশের কার অস্ত্যেষ্টিক্রিয়া । এর মধ্যে শোকের চিহ্ন নেই। না থাকবারই কথা— রাজার মৃত্যু হয়েছে অনেকদিন আগে, এতদিনে তার আত্মা, দেবসভায় উত্তীর্ণ, উৎসব তাই নিয়ে । বহু দূর থেকে গ্রামের পথে পথে মেয়ে পুরুষেরা ভারে ভারে বিচিত্ররকমের নৈবেদ্য নিয়ে আসছে ; যেন কোন পুরাণে-বৰ্ণিত যুগ হঠাৎ আমাদের চোখের সামনে বেঁচে উঠল ; যেন অজস্তার শিল্পকলা চিত্ৰলোক থেকে প্রাণলোকে সূর্যের আলো ভোগ করতে এসেছে। মেয়েদের বেশভূষা অজস্তার ছবিরই মতো । এখানে আবরণবিরলতার স্বাভাবিক আবরু সুন্দর হয়ে দেখা দিল, সেটা চারি দিকের সঙ্গে ংগত ; এমন-কি, যে-কয়েকজন আমেরিকান মিশনারি দর্শকরাপে এখানে এসেছে, আশা করি, তারাও এই দৃশ্যের সুশোভন সুরুচি সহজ-মনে অনুভব করতে পেরেছে। যজ্ঞক্ষেত্র লোকে লোকারণ্য । এই উপলক্ষে সেখানে অনেকগুলি বাশের উচু মাচাৰ্বাধা ঘরে এখানকার ব্ৰাহ্মণের সুসজ্জিত হয়ে, শিখা বেঁধে, ভূরি ভুরি খাদ্যবস্ত্ৰ ফলপুষ্প পত্রের নৈবেদের মধ্যে নানারকম মুদ্রা সহযোগে মন্ত্র পড়ছে ; তারা কেউ-বা কতরকম অর্ঘ্য-উপকরণ তৈরি করছে। কোথাও-বা। এখানকার বহুযন্ত্রমিলিত সংগীত ; একজায়গায় তাবুর মধ্যে পৌরাণিক যাত্রার অভিনয় । উৎসবের এত অতিবৃহৎ আনুষ্ঠানিক বৈচিত্ৰ্য আর কোথাও দেখি নি ; অথচ কোথাও অসুন্দর বা বিশৃঙ্খল কিছু নেই ; বিপুল সমারোহে দৃশ্যরূপটি বস্তুরাশির অসংলগ্নতায় বা জনতার ঠেলাঠেলিতে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায় নি। এতগুলি মানুষের সমাবেশ, অথচ গোলমাল বা নোংরামি বা অব্যবস্থা নেই। উৎসবের অন্তনিহিত সুন্দর ঐক্যবন্ধনেই সমস্ত ভিড়ের লোককে আপনিই সংযত করে বেঁধেছে । সমস্ত ব্যাপারটি এত বৃহৎ এত বিচিত্র, আর আমাদের পক্ষে এত অপূর্ব যে, এর বিস্তারিত বর্ণনা করা অসম্ভব । হিন্দু অনুষ্ঠানবিধির সঙ্গে এ দেশের লোকের চিত্তবৃত্তির মিল হয়ে এই যে সৃষ্টি, এর রূপের প্রাচুর্যটিই বিশেষ করে দেখবার ও ভাববার জিনিস। অপরিমিত উপকরণের দ্বারা নিজেকে অশেষভাবে প্ৰকাশ করবার চেষ্টা, সেই প্ৰকাশ কেবলমাত্র বস্তুকে পুঞ্জিত করে নয়, তাকে নানা নিপুণ রীতিতে সজ্জিত করে । জাপানের সঙ্গে এখানকার প্রাকৃতিক অবস্থার মিল আছে । জাপানের মতোই এখানে দ্বীপটি আয়তনে ছোটাে, অথচ এখানে প্রকৃতির রূপটি বিচিত্র, এবং তার সৃষ্টিশক্তি প্রচুরভাবে উর্বরা। পদে