পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী GQ@ ܠܹ ܠܹ রথী, বালিদ্বীপটি ছোটাে, সেইজন্যেই এর মধ্যে এমন একটি সুসজ্জিত সম্পূর্ণতা । গাছে-পালায় পাহাড়ে-ঝরনায় মন্দিরে-মূর্তিতে কুটিরো-ধানখেতে হাটে-বাজারে সমস্তটা মিলিয়ে যেন এক । বেখাপ কিছু চোখে ঠেকে না । ওলন্দাজ গবর্মেন্ট বাইরে থেকে কারখানা-ওয়ালাদের এই দ্বীপে আসতে বাধা । দিয়েছে ; মিশনারিদেরও এখানে আনাগোনা নেই। এখানে বিদেশীদের জমি কেনা সহজ নয়, এমন-কি, চাষবাসের জন্যেও কিনতে পারে না । আরবি মুসলমান, গুজরাটের খোজা মুসলমান, চীনদেশের ব্যাপারীরা এখানে কেনা-বেচা করে- চার দিকের সঙ্গে সেটা বোমিল হয় না । গঙ্গার ধার জুড়ে দ্বাদশ দেউলগুলিকে লজ্জিত করে বাংলাদেশের বুকের উপর জুটমিল যে নিদারুণ অমিল ঘটিয়েছে। এ সেরকম নয় । গ্রামের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ গ্রামের লোকেরই হাতে । এখানে খেতে জলসেকের আর চাষবাসের যে রীতিপদ্ধতি সে খুব উৎকৃষ্ট । এরা ফসল যা ফলায় পরিমাণে তা অন্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি । কাপড় বোনে নানা রঙচঙে ও কারুকৌশলে । অর্থাৎ, এরা কোনো মতে ময়লা ট্যানা কোমরে জড়িয়ে শরীরটাকে অনাদৃত করে রাখে না । তাই, যেখানে কোনো কারণে ভিড় জমে, বর্ণচ্ছটার সমাবেশে সেখানটা মনোরম হয়ে ওঠে । মেয়েদের উত্তর অঙ্গ অনাবৃত ৷ এ সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠলে তারা বলে, “আমরা কি নষ্ট মেয়ে যে বুক ঢাকব ।” শোনা গেল, বালিতে বেশ্যারাই বুকে কাপড় দেয় । মোটের উপর এখানকার মেয়ে-পুরুষের দেহসৌষ্ঠব ও মুখের চেহারা ভালোই । বেঢপ মোটা বা রোগা আমি তো এ-পর্যন্ত দেখি নি। এখানকার পরিপুষ্ট শ্যামল প্রকৃতির সঙ্গে এখানকার পাটল রঙের নধরদেহ গোরু, এখানকার সুস্থ সবল পরিতৃপ্ত প্ৰসন্ন ভাবের মানুষগুলি, মিলে গেছে। ছবির দিক থেকে দেখতে গেলে এমন জায়গা পৃথিবীতে খুব কমই আছে । নন্দলাল এখানে এলেন না ব’লে আমার মনে অত্যন্ত আক্ষেপ বোধ হয় ; এমন সুযোগ তিনি আর-কোথাও কখনো পাবেন না ; মনে আছে, কয়েকবৎসর আগে একজন নামজাদা আমেরিকান আর্টিস্ট আমাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, এমন দেশ তিনি আর-কোথাও দেখেন নি । আটিস্টের চোখে পড়বার মতো জিনিস। এখানে চার দিকেই। অন্নসচ্ছলতা আছে ব’লেই স্বভাবত গ্রামের লোকের পক্ষে ঘরদুয়ার আচার-অনুষ্ঠান আসবাবপত্রকে শিল্পকলায় সজ্জিত করবার চেষ্টা সফল হতে পেরেছে। কোথাও হেলা-ফেলার দৃশ্য দেখা গেল না । গ্রামে গ্রামে সর্বত্র চলছে নাচ, গান, অভিনয় ; অভিনয়ের বিষয় প্রায়ই মহাভারত থেকে । এর থেকে বোঝা যাবে, গ্রামের লোকের পেটের খাদ্য ও মনের খাদ্যের বরাদ্দ অপৰ্যাপ্ত । পথে আশে-পাশে প্রায়ই নানাপ্রকার মূর্তি ও মন্দির । দারিদ্র্যের চিহ্ন নেই, ভিক্ষুক এ-পর্যন্ত চোখে পড়ল না । এখানকার গ্রামগুলি দেখে মনে হল, এই তো যথার্থ শ্ৰীনিকেতন । গ্রামের সমগ্ৰ প্ৰাণটি সকল দিকে পরিপূর্ণ। এ দেশে উৎসবের প্রধান অঙ্গ নাচ । এখানকার নারকেলবন যেমন সমুদ্র-হাওয়ায় দুলছে তেমনি এখানকার সমস্ত দেশের মেয়ে পুরুষ নাচের হাওয়ায় আন্দোলিত । এক-একটি জাতির আত্মপ্রকাশের এক-একটি বিশেষ পথ থাকে । বাংলাদেশের হৃদয় যেদিন আন্দোলিত হয়েছিল সেদিন সহজেই কীর্তনগানে সে আপন আবেগসঞ্চারের পথ পেয়েছে ; এখনো সেটা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয় নি। এখানে এদের প্রাণ যখন কথা কইতে চায় তখন সে নাচিয়ে তোলে । মেয়ে নাচে, পুরুষ নাচে । এখানকার যাত্রী অভিনয় দেখেছি, তার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চলায়-ফেরায়, যুদ্ধে-বিগ্রহে, ভালোবাসার প্রকাশে, এমন-কি ভঁড়ামিতে, সমস্তটাই নাচ । সেই নাচের ভাষা যারা ঠিকমত জানে তারা বোধ হয় গল্পের ধারাটা ঠিকমত অনুসরণ করতে পারে। সেদিন এখানকার এক রাজবাড়িতে আমরা নাচ দেখিছিলুম । খানিক বাদে শোনা গেল, এই নাচ-অভিনয়ের বিষয়টা হচ্ছে শাহু-সত্যবতীর আখ্যান ।