পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী · · Č S G সেই সন্ধ্যাবেলাতেই রাজবাডিতে আর-একটি ব্যাপার দেখলুম, মুখোশপরা নাটেদের অভিনয় । আমরা জাপান থেকে যে-সব মুখোশ এনেছিলুম তার থেকে বেশ বোঝা যায় মুখোশ তৈরি এক প্রকারের বিশেষ কলাবিদ্যা । এতে যথেষ্ট গুণাপনা চাই । আমাদের সকলেরই মুখে। যেমন ব্যক্তিগত তেমনি শ্রেণীগত বিশেষত্ব আছে । বিশেষ ছািচ ও ভাব -প্ৰকাশ অনুসারে আমাদের মুখের ছাদ এক-একরকম শ্রেণী নির্দেশ করে । মুখোশ তৈরি যে-গুণী করে সে সেই শ্রেণী:প্রকৃতিকে মুখোশে বেঁধে দেয় । সেই বিশেষ-শ্রেণীর মুখের ভাববৈচিত্র্যকে একটি বিশেষ ছাদে সে সংহত করে । নট সেই মুখোশ পারে এলে আমরা তখনই দেখতে পাই, একটা বিশেষ মানুষকে কেবল নয়, বিশেষ ভাবের এক শ্রেণীর মানুষকে । সাধারণত, অভিনেতা ভাব অনুসারে অঙ্গভঙ্গি করে । কিন্তু, মুখোশে মুখের ভঙ্গি স্থির করে বেঁধে দিয়েছে । এইজন্যে অভিনেতার কাজ হচ্ছে মুখোশের সামঞ্জস্য রেখে অঙ্গভঙ্গি করা । মূল ধুয়োটা তার বাধা ; এমন করে তান দিতে হবে যাতে প্ৰত্যেক সুরে সেই ধুয়োটার ব্যাখ্যা হয়, কিছু অসংগত না হয় । এই অভিনয়ে তাই দেখলুম। অভিনয়ের সঙ্গে এদের কণ্ঠসংগীত যা শুনেছি তাকে সংগীত বলাই চলে না । আমাদের কানে অত্যন্ত বেসুরো এবং উৎকট ঠেকে । এখানে আমরা তো গ্রামের কাছেই আছি ; এরা কেউ একলা কিংবা দল বেঁধে গান গাচ্ছে, এ তো শুনি নি । আমাদের পাড়াগায়ে চাদ উঠেছে অথচ কোথাও গান ওঠে নি, এ সম্ভব হয় না । এখানে সন্ধ্যার আকাশে নারকেলগাছগুলির মাথার উপর শুক্লপক্ষের চাদ দেখা দিচ্ছে, গ্রামে কুঁকড়ো ডাকছে, কুকুর ডাকছে, কিন্তু কোথাও মানুষের গান নেই । এখানকার একটা জিনিস বার বার লক্ষ্য করে দেখেছি, ভিড়ের লোকের আত্মসংযম । সেদিন গিয়ািনয়ারের রাজবাড়িতে যখন অভিনয় হচ্ছিল চার দিকে অবারিত লোকের সমাগম । সুনীতিকে ডেকে বললুম, মেয়েদের কোলে শিশুদের আর্তরব শুনি নে কেন । নারীকণ্ঠই বা এমন সম্পূর্ণ নীরব থাকে কোন আশ্চর্য শাসনে । মনে পড়ে, কলকাতার থিয়েটার মেয়েদের কলালাপ ও শিশুদের কাল্পী বন্যার মতো কমেডি ও ট্র্যাজেডি ছাপিয়ে দিয়ে কিরকম অসংযত অসভ্যতার হিল্লোল তোলে । সেদিন এখানে দুই-একটি মেয়ের কোলে শিশুও দেখেছি কিন্তু তারা কঁাদল না কেন । একটা জিনিস। এখানে দেখা গেল। যা আর কোথাও দেখি নি । এখানকার মেয়েদের গায়ে গহনা নেই । কখনো কখনো কারও এক হাতে একটা চুড়ি দেখেছি, সেও সোনার নয় । কানে ছিদ্র করে শুকনো তালপাতার একটি গুটি পরেছে। বোধ হচ্ছে, যেন অজস্তার ছবিতেও এরকম কর্ণভূষণ দেখেছি। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এদের আর-সকল কাজেই অলংকারের বাহুল্য ছাড়া বিরলতা নেই । যেখানে সেখানে পাথরে কাঠে কাপড়ে নানা ধাতুদ্রিব্যে এরা বিচিত্ৰ অলংকার সমস্ত দেশে ছড়িয়ে রেখেছে, কেবল এদের মেয়েদের গায়েই অলংকার নেই । আমাদের দেশে সাধারণত দেখা যায়, অলংকৃত জিনিসের প্রধান রচনাস্থান পুরোনো শহরগুলি যেখানে মুসলমান বা হিন্দু প্রভাব সংহত ছিল, যেমন দিল্লি, আগ্রা, ঢাকা, কাশী, মাদুরা প্রভৃতি জায়গা । এখানে সেরকম বোধ হল না । এখানে শিল্পকাজ কম-বেশি সর্বত্র ও সর্বসাধারণের মধ্যে; ছড়ানো । তার মানে, এখানকার লোক ধনীর ফরম্যাশে নয়, নিজের আনন্দেই নিজের চার দিককে সজ্জিত করে । কতকটা জাপানের মতো । তার কারণ, অল্প-পরিসর দ্বীপের মধ্যে আইডিয়া এবং বিদ্যা ছড়িয়ে যেতে বিলম্ব হয় না । তা ছাড়া এদের মধ্যে জাতিগত ঐক্য । সেই সমজাতীয় মনোবৃত্তিতে শক্তির সাম্য দেখা যায় । দ্বীপ মাত্রের একটি স্বাভাবিক বিশেষত্ব এই যে, সেখানকার মানুষ সমুদ্রবেষ্টিত হয়ে বহুকাল নিজের বিশেষ নৈপূণ্যকে অব্যাঘাতে ঘনীভূত করতে ও তাকে রক্ষা করতে পারে । আমাদের অতিবিস্তৃত ভারতবর্ষে এক কালে যা প্রচুর হয়ে উৎপন্ন হয় অন্য কালে তা ছড়িয়ে নষ্ট হয়ে যায় । তাই আমাদের দেশে অজন্তা আছে অজস্তার কালকেই আঁকড়ে ; কানারক আছে কনারকেরই যুগে ; তারা আর একাল পর্যন্ত এসে পৌছতে পারলে না । শুধু তাই নয়, তত্ত্বজ্ঞান ভারতীয় মনের প্রধান সম্পদ, কিন্তু বহু দূরে দূরে উপনিষদের বা শঙ্করাচার্যের কালে তা ভাগে ভাগে লগ্ন হয়ে রইল । একালে আমরা শুধু তাই নিয়ে আবৃত্তি করি। কিন্তু তার সৃষ্টিধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে । ভারতবর্ষ থেকে