পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী GVG মনে হয়, অজস্তার ছবিটি । এমনতরো বাহুল্যবর্জিত সুপরিচ্ছন্নতার সামঞ্জস্য আমি কখনো দেখি নি । আমাদের নর্তকী বাইজিদের আঁটপায়জামার উপর অত্যন্ত জীবড়জঙ্গ কাপড়ের অসৌষ্ঠবতা চিরদিন আমাকে ভারি কুশ্রী লেগেছে ! তাদের প্রচুর গয়না ঘাগরা ওড়না ও অত্যন্ত ভারী দেহ মিলিয়ে প্রথমেই মনে হয়, সাজানো একটা মস্ত বোঝা । তার পরে মাঝে মাঝে বাটা থেকে পান খাওয়া, অনুবতীদের সঙ্গে কথা কওয়া, ভুরু ও চোখের নানাপ্রকার ভঙ্গিমা ধিক্কারজনক বলে বোধ হয়নীতির দিক থেকে নয়, রীতির দিক থেকে । জাপানে ও জাভাতে যে-নাচ দেখলুম তার সৌন্দর্য যেমন তার শালীনতাও তেমনি নিখুঁত । আমরা দেখলুম, এই দুটি বালিকার তনু দেহকে সম্পূর্ণ অধিকার করে অশরীরী নাচেরই আবির্ভাব । বাক্যকে অধিকার করেছে কাব্য, বচনকে পেয়ে বসেছে বচনাতীত । শুনেছি, অনেক যুরোপীয় দর্শক এই নাচের অতিমৃদুতা ও সৌকুমাৰ্য ভালোই বাসে না । তারা উগ্ৰ মাদকতায় অভ্যস্ত বলে এই নাচকে একঘেয়ে মনে করে । আমি তো এ নাচে বৈচিত্র্যের একটু অভাব দেখলুম না ; সেটা অতি প্ৰকট নয় বলেই যদি চোখে না পড়ে তবে চোখেরই অভ্যাসদোষ । কেবলই আমার এই মনে হচ্ছিল যে, এ হচ্ছে কলাসৌন্দর্যের একটি পরিপূর্ণ সৃষ্টি, উপাদােনরূপে মানুষটি তার মধ্যে একেবারে হারিয়ে গেছে । নাচ হয়ে গেলে এরা যখন বাজিয়েদের মধ্যে এসে বসল। তখন তারা নিতান্তই সাধারণ মানুষ । তখন দেখতে পাওয়া যায়, তারা গায়ে রঙ করেছে, কপালে চিত্র করেছে, কাপড় পরেছে- সাধারণ মানুষের পক্ষে এ সমস্তই অসংগত, এতে চোখকে পীড়া দেয় । কিন্তু, সাধারণ মানুষের এই রূপান্তর নৃত্যকলায় অপরূপই হয়ে ওঠে । পরদিন সকালে আমরা প্রাসাদের অন্যান্য বিভাগে ও অন্তঃপুরে আহূত হয়েছিলেম । সেখানে স্তম্ভশ্রেণীবিধৃত অতি বৃহৎ একটি সভামণ্ডপ দেখা গেল ; তার প্রকাণ্ড ব্যাপ্তি অথচ সুপরিমিত বাস্তুকলার সৌন্দর্য দেখে ভারি আনন্দ পেলুম । এ-সমস্তর উপযুক্ত বিবরণ তোমরা নিশ্চয় সুরেন্দ্রের চিঠি ও চিত্র থেকে পাবে । অন্তঃপুরে অপেক্ষাকৃত ছোটাে একটি মণ্ডপে গিয়ে দেখি সেখানে আমাদের গৃহকর্তা ও গৃহস্বামিনী বসে আছেন । রানীকে ঠিক যেন একজন সুন্দরী বাঙালী মেয়ের মতো দেখতে ; বডো বড়ো চোখ, স্নিগ্ধ হাসি, সংযত সৌষম্যের মর্যাদা ভারি তৃপ্তিকর । মণ্ডপের বাইরে গাছপালা, আর নানারকম খাচায় নানা পাখি | মণ্ডপের ভিতরে গানবাজনার, ছায়াভিনয়ের, মুখোশের অভিনয়ের, পুতুলনাচের নানা সরঞ্জাম । একটা টেবিলে বর্তিক শিল্পের অনেকগুলি কাপড় সাজানো । তার মধ্যে থেকে আমাকে তিনটি কাপড় পছন্দ করে নিতে অনুরোধ করলেন । সেইসঙ্গে আমার দলের প্ৰত্যেককে একটি একটি করে এই মূল্যবান কাপড় দান করলেন । কাপড়ের উপর এইরকম শিল্পকাজ করতে দু-তিন মাস করে লাগে। রাজবাড়ির পরিচারিকারাই এই কাজে সুনিপুণ । এই রাজবংশীয়দের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পরিবারের র্যারা, কাল রাত্রে তাদের ওখানে নিমন্ত্রণ ছিল । তার ওখানে রাজকায়দার যতরকমের উপসৰ্গ । যেমন, দুই সারস পাখি পরস্পরকে ঘিরে ঘিরে নানা গভীর ভঙ্গিতে নাচে দেখেছি, এখানকার রেসিডেনট আর এই রাজা পরস্পরকে নিয়ে সেইরকম রাজকীয় চাল বিস্তার করতে লাগলেন । রাজা কিংবা রাজপুরুষদের একটা পদোচিত মর্যাদা বাইরের দিক থেকে রক্ষা করে চলতে হয় মানি ; তাতে সেই-সব মানুষের সামান্যতা কিছু ঢাকাও পড়ে, কিন্তু বাড়াবাড়ি করলে তাতে তাদের সাধারণতাকেই হাস্যকরভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয় । কাল রাত্রে যে-নাচ হল সে ন'জন মেয়েতে মিলে । তাতে যেমন নৈপুণ্য তেমনি সৌন্দর্য, কিন্তু দেখে মনে হল, কাল রাত্রের সেই নাচে স্বত-উচ্ছসিত প্ৰাণের উৎসাহ ছিল না ; যেন এরা ক্লাস্ত, কেবল অভ্যাসের জোরে নোচে যাচ্ছে । কালকের নাচে গুণাপনা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তেমন করে মনকে স্পর্শ করতে পারে নি । রাজার একটি ছেলে পাশে বসে আমার সঙ্গে আলাপ করছিলেন, তাকে আমার বড়ো ভালো লাগল। অল্প বয়স, দুই বছর হল্যান্ডে শিক্ষা পেয়েছেন, ওলন্দাজ গবর্নমেন্টের সৈনিকবিভাগে প্রধান পদে নিযুক্ত । তার চেহারায় ও ব্যবহারে স্বাভাবিক আকর্ষণীশক্তি আছে। কাল রাত্রে আমাদের এখানেও একটা নাচ হয়ে গেল । পূর্বরাত্রে যে-দুজন বালিকা নেচেছিল তাদের