পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ○○ রবীন্দ্র-রচনাবলী মধ্যে একজন আজ পুরুষ-সঙের মুখোশ পরে সঙের নাচ নাচলে । আশ্চর্য ব্যাপারটা হচ্ছে, এর মধ্যে নাচের শ্ৰী সম্পূর্ণ রক্ষা করেও ভাবে-ভঙ্গিতে গলার আওয়াজে পুরোমাত্রায় বিদূষকতা করে গেল । পুরুষের মুখোশের সঙ্গে তার অভিনয়ের কিছুমাত্র অসামঞ্জস্য হল না। বেশভূষার সৌন্দর্যেও একটুমাত্র ব্যত্যয় হয় নি । নাচের শোভনতাকে বিকৃত না করেও যে তার মধ্যে ব্যঙ্গবিদ্রুপের রস এমন করে আনা যেতে পারে, এ আমার কাছে আশ্চর্য ঠেকাল । এরা প্ৰধানত নাচের ভিতর দিয়েই সমস্ত হৃদয়ভােব ব্যক্তি করতে চায়, সুতরাং বিদ্রুপের মধ্যেও এরা ছন্দ রাখতে বাধ্য। এরা বিদ্রুপকেও বিরূপ করতে পারে না ; এদের রাক্ষসেরাও নাচে । ইতি ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯২৭ * S 8 কল্যাণীয়াসু বীেমা, শেষ চিঠিতে তোমাকে এখানকার নাচের কথা লিখেছিলুম, ভেবেছিলুম, নাচ সম্বন্ধে শেষ কথা বলা হয়ে গেল । এমন সময়ে সেই রাত্রে আর-এক নাচের বৈঠকে ডাক পড়ল । সেই অতিপ্ৰকাণ্ড মণ্ডপে আসর ; বহুবিস্তীর্ণ শ্বেত পাথরের ভিত্তিতলে বিদ্যুদীপের আলো ঝলমল করছে । আহারে বসবার আগে নাচের একটা পালা আরম্ভ হল- পুরুষের নাচ, বিষয়টা হচ্ছে ইন্দ্ৰজিতের সঙ্গে হনুমানের লড়াই । এখানকার রাজার ভাই ইন্দ্ৰজিত সেজেছেন ; ইনি নৃত্যবিদ্যায়। ওস্তাদ । আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বয়ঃপ্ৰাপ্ত অবস্থায় ইনি নাচ শিখতে আরম্ভ করেছেন । অল্প বয়সে সমস্ত শরীরটা যখন নম্র থাকে, হাড় যখন পাকে নি, সেই সময়ে এই নাচ শিক্ষা করা দরকার ; দেহের প্রত্যেক গ্ৰন্থি যাতে অতি সহজে সরে, প্ৰত্যেক মাংসপেশিতে যাতে অনায়াসে জোর পৌঁছয়, এমন অভ্যাস করা চাই । কিন্তু, নাচ সম্বন্ধে রাজার ভাইয়ের স্বাভাবিক প্ৰতিভা থাকাতে তাকে বেশি চেষ্টা করতে হয় নি । হনুমান বনের জন্তু, ইন্দ্ৰজিত সুশিক্ষিত রাক্ষস, দুইজনের নাচের ভঙ্গিতে সেই ভাবের পার্থক্যটি বুঝিয়ে দেওয়া চাই, নইলে রসভঙ্গ হয় । প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে সে হচ্ছে এদের সাজ । সাধারণত করবার চেষ্টা হয় । এখানে হনুমানের আভাসটুকু দেওয়াতে তার মনুষ্যত্ব আরো বেশি উজ্জ্বল হয়েছে। হনুমানের নাচে লম্বফ-ঝম্বফ দ্বারা তার বানরস্বভাব প্রকাশ করা কিছুই কঠিন হত না, আর সেই উপায়ে সমস্ত সভা অনায়াসেই অট্টহাস্যে মুখরিত হয়ে উঠত, কিন্তু কঠিন কাজ হচ্ছে হনুমানকে মহত্ত্ব দেওয়া । বাংলাদেশের অভিনয় প্রভৃতি দেখলে বোঝা যায় যে, হনুমানের বীরত্ব, তার একনিষ্ঠ ভক্তি ও আত্মত্যাগের চেয়ে- তার লেজের দৈর্ঘ্য, তার পোড়ামুখের ভঙ্গিমা, তার বানরত্বই বাঙালির মনকে বেশি করে অধিকার করেছে । আমাদের পশ্চিমাঞ্চলে তার উলটাে । এমন-কি, হনুমানপ্ৰসাদ নাম রাখতে বাপমায়ের দ্বিধা বোধ হয় না । বাংলায় হনুমানচন্দ্র বা হনুমানেন্দ্র আমরা কল্পনা করতে পারি নে । এ দেশের লোকেরাও রামায়ণের হনুমানের বড়ো দিকটাই দেখে । নাচে হনুমানের রূপ দেখলুম- পিঠ বেয়ে মাথা পর্যন্ত লেজ, কিন্তু এমন একটা শোভনভঙ্গি যে দেখে হাসি পাবার জো নেই। আর-সমস্তই মানুষের মতো । মুকুট থেকে পা পর্যন্ত ইন্দ্ৰজিতের সাজসজ্জা একটি সুন্দর ছবি । তার পরে দুইজনে নাচতে নাচতে লড়াই ; সঙ্গে সঙ্গে ঢাকে-ঢোলে কাসরে-ঘণ্টায় নানাবিধ যন্ত্রে ও মাঝে মাঝে বহু মানুষের কণ্ঠের গর্জনে সংগীত খুব গভীর প্রবল ও প্ৰমত্ত হয়ে উঠছে। অথচ, সে সংগীত শ্রুতিকটু একটুও নয় ; বহুযন্ত্রসম্মিলনের সুশ্রাব্য নৈপুণ্য তার উদ্দামতার সঙ্গে চমৎকার नन्शिनिट । ১ প্ৰতিমা দেবীকে লিখিত ।