পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G8 by রবীন্দ্র-রচনাবলী কল্যাণীয়েষ্ণু অমিয়, অক্টোবর শুরু হল, বোধ হচ্ছে এখন তোমাদের পুজোর ছুটি ; আন্দাজ করছি, ছুটি ভোগ করবার জন্যে আশ্রম ত্যাগ করা তুমি প্রয়োজন বোধ করা নি । নিশ্চয়ই তোমার ছুটির জোগান দেবার ভার দিয়েছ। শান্তিনিকেতনের প্রফুল্লকশগুচ্ছবীজিত শরৎপ্রকৃতির উপরে । পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে অন্তত এই বুদ্ধি আমার মাথায় এসেছে যে, ঘুরে বেড়িয়ে বেশি কিছু লাভ নেই, এ যেন চালুনিতে জল আনবার চেষ্টা, পথে-পথেই প্ৰায় সমস্তটা নিকেশ হয়ে যায় । আধুনিক কালের ভ্ৰমণ জিনিসটা উদ্ধৃবৃত্তির মতো, যা ছড়িয়ে আছে তাকে খুঁটে খুঁটে কুড়িয়ে কুড়িয়ে চলা । নিজের সুদূর ভরা খেতে আঁটিবাধা ফসলের স্মৃতিটা মনে কেবলই জেগে ওঠে । এবারকার যাত্রায় দেশের চিঠিপত্র ও খবরবার্তা প্ৰায় কিছু পাই নি বলে মনে হচ্ছে যেন জন্মান্তর গ্ৰহণ করেছি। এ জন্মের প্রত্যেকদিনের স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি সাবেকজন্মের অন্তত সাতদিনের তুল্য। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন ঘটনার চলমান যুথপ্রবাহ একেবারে ঠাসাঠাসি হয়ে হুহু করে চলেছে । এই চলার মাপেই মন তোমাদেরও সময়ের বিচার করছে। রেলগাডির আরোহী যেমন মনে করে, তার গাড়ির বাইরে নদীগিরিবন হঠাৎ কালের তাড়া খেয়ে উধৰ্বশ্বাসে দৌড় দিয়েছে, তেমনি এই দ্রুত বেগবান সময়ের কাধে চড়ে আমারও মনে হচ্ছে, তোমাদের ওখানেও সময়ের বেগ বুঝি এই পরিমাণেই— সেখানে আজ-গুলো বুঝি কাল-গুলোকে ডিঙিয়ে একেবারে পরশুর ঘাড়ে গিয়ে পড়ছে, মুকুলের সঙ্গে ফলের বয়সের ভেদ সেখানে বুঝি ঘুচিল । দূরে বসে যখন বোরোবুন্দর বালি প্রভৃতির কথা ভেবেছি তখন সেই ভাবনাকে একটা বিস্তৃত কালের উপর মেলে দিয়ে কল্পনা করেছি, নইলে অতখানি পদার্থ ধরাবার জায়গা পাওয়া যায় না । এই কয়দিনেই সে-সমস্ত তাড়াতাড়ি সংগ্ৰহ করা গেল ; যা স্বপ্নের মধ্যে আকীর্ণ হয়ে ছিল তা প্ৰত্যক্ষের মধ্যে সংকীর্ণ হয়ে এল। দূরে সময়ের যে-মাপ অস্ফুটিতার মধ্যে মস্ত হয়ে ছিল, কাছে সেই সময়টাই ঘন হয়ে উঠল। হিসেব করে দেখলে, আমার এই কয়দিনের আয়ুতে অল্পকালের মধ্যে অনেকখানি কালকে ঠেসে দেওয়া হয়েছে । চণ্ডীমণ্ডপে মন্দগমনে যার দিন চলে তার বয়সটার অনেকখানি বাদ দিলে তবে খাটি আয়ুটুকুর মধ্যে পৌছনো যায় ; অর্থাৎ কেবলমাত্র কালের পরিমাণে তার আয়ুর দাম দিতে গেলে ঠকতে হয়, অনেক দর-কষাকষি করেও দুধে পৌঁছনো শক্ত হয়ে ওঠে । তাই বলে এ কথা বলাও চলে না যে, দ্রুতবেগে দেশবিদেশে অনেকগুলো ব্যাপার-পরম্পরার মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে চললেই আয়ু সেই অনুসারে কালকে ব্যাপ্ত করে । আমাদের শাস্ত্রীমশায়কে দেখো-না । তিনি কোণেই বসে আছেন । কিন্তু, সেইটুকুর মধ্যে স্থির হয়ে থেকে কালকে তিনি কিরকম ব্যাপকভাবে অধিকার করতে করতে চলেছেন ; সাধারণ লোকের বয়সের বাটখারায় মাপলে তার বয়স নকবই ছাড়িয়ে যায় । এই তো সেদিন এলেন আশ্রমে মিত্ৰগোষ্ঠীর সম্পাদকপদ থেকে নেমে । এসেই তার মন দৌড় দিল পালিশাস্ত্রের মহারণ্যের মধ্যে । দ্রুতবেগে পার হয়ে চলেছেন- কোথায় তিব্বতি, কোথায় চৈনিক । নাগাল পাবার জো নেই। তাই বলছি, আমাদের এই ভ্ৰমণের কালটা ব্যাপ্তির দিকে যেরকম প্ৰাপ্তির দিকে সেরকম নয় । আমাদের ভ্রমণের তালটা চৌদুন লয়ে । এই লয় তো আমাদের জীবনের অভ্যস্ত লয় নয়, তাই বাইরের দ্রুতগতির সঙ্গে সঙ্গে অন্তরকে চালাতে গিয়ে হয়রান হয়ে পড়তে হয়। যেমন চিবিয়ে না খেলে খাদ্যটাকে খাদ্য বলেই মনে হয় না তেমনি হুড়মুড়ে করে কাজ করাকে কর্তব্য বলে উপলব্ধি করা যায় না । বিশ্বের উপর দিয়ে ভাসা-ভাসা ভাবে মন বুলিয়ে চলেছি ; অভিজ্ঞতার পেয়ালা ধরে ফেনাটাতে মুখ ঠেকাবার জন্যে এক সেকেন্ড মেয়াদ পাওয়া যায়, পানীয় পর্যন্ত পৌছবার সময় নেই। মৌমাছিকে ঝোড়ো হাওয়ার তাড়া খেয়ে কেবল যদি উড়তেই হয়, ফুলের উপর একটুমাত্র পা ছুইয়েই তখনই যদি সে ছিটকে পড়ে, তা হলে তার ঘুরে-বেড়ানোটা যেমন ব্যর্থ হয়, আমার মনও তেমনি ব্যর্থতার দমকা হাওয়ায় ভন ভন করেই মোলো- তার চলার সঙ্গে পৌছনোর যোগ হারিয়ে গেছে। এর থেকে স্পষ্ট