পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মস্কেী রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল । যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে । অন্য কোনো দেশের মতোই নয় । একেবারে মূলে প্ৰভেদ । আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে । চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশি, তারাই বাহন ; তাদের মানুষ হবার সময় নেই ; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত । সব চেয়ে কম খেয়ে, কম পারে, কম শিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে ; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান । কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি বঁটা খেয়ে মরে— জীবনযাত্রার জন্য যত৷-কিছু সুযোগ সুবিধে সবা-কিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত । তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্ৰদীপ নিয়ে খাড়া দাড়িয়ে থাকে- উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা আমি অনেকদিন এদের কথা ভেবেছি, মনে হয়েছে এর কোনো উপায় নেই | এক দল। তলায় না। থাকলে আর-একদল উপরে থাকতেই পারে না, অথচ উপরে থাকার দরকার আছে। উপরে না থাকলে নিতান্ত কাছের সীমার বাইরে কিছু দেখা যায় না । কেবলমাত্র জীবিকানির্বাহ করার জন্যে তো মানুষের মনুষ্যত্ব নয় । একান্ত জীবিকাকে অতিক্রম করে তবেই তার সভ্যতা । সভ্যতার সমস্ত শ্রেষ্ঠ ফসল অবকাশের ক্ষেত্রে ফলেছে । মানুষের সভ্যতায় এক অংশে অবকাশ রক্ষা করার দরকার আছে । তাই ভাবতুম, যে-সব মানুষ শুধু অবস্থার গতিকে নয়, শরীরমনের গতিকে নীচের তলায় কাজ করতে বাধ্য এবং সেই কাজেরই যোগ্য, যথাসম্ভব তাদের শিক্ষাস্বাস্থ্য-সুখসুবিধার জন্যে চেষ্টা করা উচিত । মুশকিল এই, দয়া করে কোনো স্থায়ী জিনিস করা চলে না ; বাইরে থেকে উপকার করতে গেলে পদে পদে তার বিকার ঘটে । সমান হতে পারলে তবেই সত্যকার সহায়তা সম্ভব হয় । যাই হােক, আমি ভালো করে কিছুই ভেবে পাই নি, অথচ অধিকাংশ মানুষকে তলিয়ে রেখে, অমানুষ করে রেখে, তবেই সভ্যতা সমুচ্চে থাকবে এ কথা অনিবাৰ্য বলে মেনে নিতে গেলে মনে ধিককার আসে । ভেবে দেখো-না, নিরন্ন ভারতবর্ষের অন্নে ইংলণ্ড পরিপুষ্ট হয়েছে। ইংলন্ডের অনেক লোকেরই মনের ভাব এই যে, ইংলন্ডকে চিরদিন পোষণ করাই ভারতবর্ষের সার্থকতা । ইংলন্ড বড়ো হয়ে উঠে মানবসমাজে বড়ো কাজ করছে, অতএব এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে চিরকালের মতো একটা জাতিকে দাসত্বে বদ্ধ করে রেখে দিলে দোষ নেই । এই জাতি যদি কম খায়, কম পরে, তাতে কী যায় আসেতবুও দয়া করে তাদের অবস্থার কিছু উন্নতি করা উচিত, এমন কথা তাদের মনে জাগে । কিন্তু একশো বছর হয়ে গেল ; না পেলুম শিক্ষা, না পেলুম স্বাস্থ্য, না পেলুম সম্পদ । , প্ৰত্যেক সমাজের নিজের ভিতরেও এই একই কথা । যে মানুষকে মানুষ সম্মান করতে পারে না সে মানুষকে মানুষ উপকার করতে অক্ষম । অন্তত যখনই নিজের স্বার্থে এসে ঠেকে তখনই মারামারি কাটাকাটি বেধে যায় । রাশিয়ায় একেবারে গোড়া ঘেঁষে এই সমস্যা সমাধান করবার চেষ্টা চলছে। তার শেষ ফলের কথা এখনো বিচার করবার সময় হয় নি, কিন্তু আপাতত যা চোখে পড়ছে তা দেখৈ আশ্চর্য হচ্ছি। আমাদের সকল সমস্যার সব চেয়ে বড়ো রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের SO} \OV