পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(k\ኃbr রবীন্দ্র-রচনাবলী জীবিকার উন্নতি হতে পারে। আত্মপ্রকাশের উচ্চতন উপায়, যেমন বুদ্ধি, যেমন গুণাপনা, কেউ কারও কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিতে পারে না ; সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া চলে, ফাকি দেওয়া চলে। সেই কারণে সম্পত্তি-বিভাগ ও ভোগ নিয়ে সমাজে এত নিষ্ঠুরতা, এত ছলনা, এত অন্তহীন বিরোধ । এর একটা মাঝামাঝি সমাধান ছাড়া উপায় আছে বলে মনে করি নে ; অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে অথচ তার ভোগের একান্ত স্বাতন্ত্র্যাকে সীমাবদ্ধ করে দিতে হবে । সেই সীমার বাইরেকার উদবুত্ত অংশ সর্বসাধারণের জন্যে ছাপিয়ে যাওয়া চাই। তা হলেই সম্পত্তির মমত্ব লুব্ধতার প্রতারণায় বা নিষ্ঠুরতায় গিয়ে পৌঁছয় না। সোভিয়েটরা এই সমস্যাকে সমাধান করতে গিয়ে তাকে অস্বীকার করতে চেয়েছে । সেজন্যে জবরদস্তির সীমা নেই। এ কথা বলা চলে না যে, মানুষের স্বাতন্ত্র্য থাকবে না ; কিন্তু বলা চলে যে, স্বার্থপরতা থাকবে না। অর্থাৎ নিজের জন্যে কিছু নিজত্ব না হলে নয়, কিন্তু বাকি সমস্তই পরের জন্যে হওয়া চাই । আত্ম এবং পর উভয়কেই স্বীকার করে তবেই তার সমাধান সম্ভর । কোনো একটাকে বাদ দিতে গেলেই মানবচরিত্রের সত্যের সঙ্গে লড়াই বেধে যায়। পশ্চিম মহাদেশের মানুষ জোর জিনিসটাকে অত্যন্ত বেশি বিশ্বাস করে । যে ক্ষেত্রে জোরের যথার্থ কাজ আছে সে ক্ষেত্রে সে খুবই ভালো, কিন্তু অন্যত্র সে বিপদ ঘটায় । সত্যের জোরকে গায়ের জোরের দ্বারা যত প্রবলভাবেই আমরা মেলাতে চেষ্টা করি একদা তত প্রবলভাবেই তাদের বিচ্ছেদ ঘটে । মধ্য-এশিয়ার বাসকির রিপাব্লিকের (Bashkiri Republic) একজন চাষী বললে, “আজও আমার নিজের স্বতন্ত্র খেত আছে, কিন্তু নিকটবতী ঐকত্রিক কৃষিক্ষেত্রে আমি শীঘ্রই যোগ দেব । কেননা, দেখছি, স্বাতন্ত্রিক প্ৰণালীর চেয়ে ঐকত্রিক প্ৰণালীতে ঢের ভালো ডুজাতের এবং অধিক পরিমাণে ফসল উৎপন্ন করানো যায়। যেহেতু প্ৰকৃষ্টভাবে চাষ করতে গেলেই যন্ত্র চাই ; ছোটাে খেতের মালিকের পক্ষে যন্ত্র কেনা চলে না । তা ছাড়া, আমাদের টুকরো জমিতে যন্ত্রের ব্যবহার অসম্ভব ।” আমি বললুম, “কাল একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীর সঙ্গে আলাপ হল । তিনি বললেন, মেয়েদের এবং শিশুদের সর্বপ্রকার সুযোগের জন্য সোভিয়েট গবর্মেন্টের দ্বারা যেরকম সব ব্যবস্থা হয়েছে এরকম আর কোথাও হয় নি। আমি তাকে বললুম, তোমরা পারিবারিক দায়িত্বকে সরকারী দায়িত্ব করে তুলে হয়তো পরিবারের সীমা লোপ করে দিতে চাও । তিনি বললেন, সেটাই যে আমাদের আশু সংকল্প তা নয়- কিন্তু শিশুদের প্রতি দায়িত্বকে ব্যাপক করে দিয়ে যদি স্বভাবতই একদা পরিবারের গণ্ডি লোপ পায় তা হলে এই প্রমাণ হবে, সমাজে পরিবারিক যুগ আপনি সংকীর্ণতা এবং অসম্পূর্ণতা -বশতই নবযুগের প্রসারের মধ্যে আপনিই অন্তর্ধন করেছে। যা হােক, এ সম্বন্ধে তোমাদের কী মত জানতে ইচ্ছে করি । তোমরা কি মনে করা যে, তােমাদের একত্রীকরণের নীতি বজায় রেখে পরিবার বজায় থাকতে পারে ।” প্রভাব বিস্তার করেছে আমার নিজের দিক থেকে তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। আমার পিতা যখন বেঁচে ছিলেন, শীতের ছয় মাস তিনি শহরে কাজ করতেন। আর গরমের ছয় মাস ভাইবোনদের নিয়ে আমি ধনীর চাকরি নিয়ে পশুচারণ করতে যৌতুম । বাবার সঙ্গে আমাদের দেখা প্রায়ই হত না । এখন এরকম বিচ্ছেদ ঘটে না । শিশুবিদ্যালয় থেকে আমার ছেলে রোজ ফিরে আসে, রোজই তার সঙ্গে দেখা হয় ।” 鸣 একজন চাষী-মেয়ে বললে, “শিশুদের দেখাশোনা ও শেখানোর স্বতন্ত্র ব্যবস্থা হওয়াতে স্বামীস্ট্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাটি ঢের কমে গেছে। তা ছাড়া, ছেলেদের সম্বন্ধে দায়িত্ব যে কতখানি তা বাপ-মা ভালো । করে শিখতে পারছে ।” বিশেষ করেই অনুভব করি যে, অক্টোবরের বিপ্লবের পর থেকে আমরা যথার্থ স্বাধীনতা এবং সুখ পেয়েছি। আমরা নতুন যুগ সৃষ্টি করতে প্ৰবৃত্ত, তার কঠিন দায়িত্ব খুবই বুঝি, তার জন্যে চূড়ান্ত