পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

GAO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী दक्ॉिन রাশিয়া ঘুরে এসে আজ আমেরিকার মুখে চলেছি, এমন সন্ধিক্ষণে তোমার চিঠি পেলুম । রাশিয়ায় গিয়েছিলুম ওদের শিক্ষাবিধি দেখবার জন্যে । দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছি। আট বছরের মধ্যে শিক্ষার জোরে সমস্ত দেশের লোকের মনের চেহারা বদলে দিয়েছে। যারা মূক ছিল তারা ভাষা পেয়েছে, যারা মূঢ় ছিল তাদের চিত্তের আবরণ উদঘাটিত, যারা অক্ষম ছিল তাদের আত্মশক্তি জাগরকে, যারা আসন পাবার অধিকারী । এত প্ৰভূত লোকের যে এত দ্রুত এমন ভাবান্তর ঘটতে পারে, তা কল্পনা করা কঠিন । এদের এক কালের মরা গাঙে শিক্ষার প্লাবন বয়েছে দেখে মন পুলকিত হয় । দেশের এক প্ৰান্ত থেকে আর-এক প্ৰান্ত সচেষ্ট সচেতন । এদের সামনে একটা নূতন আশার বীথিকা দিগন্ত পেরিয়ে অবারিত ; সর্বত্র জীবনের বেগ পূৰ্ণমাত্রায় । - এরা তিনটে জিনিস নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত আছে। শিক্ষা, কৃষি এবং যন্ত্র । এই তিন পথ দিয়ে এরা সমস্ত জাতি মিলে চিত্ত, অন্ন এবং কর্মশক্তিকে সম্পূর্ণতা দেবার সাধনা করছে । আমাদের দেশের মতোই এখানকার মানুষ কৃষিজীবী । কিন্তু আমাদের দেশের কৃষক এক দিকে মূঢ়, আর-এক দিকে অক্ষম ; শিক্ষা এবং শক্তি দুই থেকেই বঞ্চিত । তার একমাত্র ক্ষীণ আশ্রয় হচ্ছে প্ৰথা— পিতামহের আমলের চাকরের মতো সে কাজ করে কম, অথচ কর্তৃত্ব করে বেশি । তাকে মেনে চলতে হলে তাকে এগিয়ে চলবার উপায় থাকে না । অথচ শত শত বৎসর থেকে সে খুঁড়িয়ে চলছে। আমাদের দেশে কোনো-এক সময়ে গোবর্ধনধারী কৃষ্ণ বোধ হয় ছিলেন কৃষির দেবতা, গোয়ালার ঘরে তার বিহার ; তার দাদা বলরাম, হলধর । ঐ লাঙল-অস্ত্রটা হল মানুষের যন্ত্রবলের প্রতীক । কৃষিকে বল দান করেছে। যন্ত্র । আজকের দিনে আমাদের কৃষিক্ষেত্রের কোনো কিনারায় বলরামের দেখা নেই।— তিনি লজিজত— যে দেশে তার অস্ত্ৰে তেজ আছে সেই সাগরপারে তিনি চলে গেছেন । রাশিয়ার কৃষি বলরামকে ডাক দিয়েছে ; দেখতে দেখতে সেখানকার কেদারখণ্ডগুলো অখণ্ড হয়ে উঠল, তার নূতন হলের স্পর্শে অহল্যাভূমিতে প্রাণসঞ্চার হয়েছে। একটা কথা আমাদের মনে রাখা উচিত, রামেরই হলযন্ত্রীধারী রূপ হচ্ছে বলরাম । ১৯১৭ খৃস্টাব্দে এখানে যে বিপ্লব হয়ে গেল তার আগে এ দেশে শতকরা নিরানব্বই জন চাষী আধুনিক হলযন্ত্র চক্ষেও দেখে নি । তারা সেদিন আমাদেরই চাষীদের মতো সম্পূর্ণ দুর্বলরাম ছিল, নিরন্ন, নিঃসহায়, নির্বাক । আজ দেখতে দেখতে এদের খেতে হাজার হাজার হলযন্ত্র নেমেছে। আগে এরা ছিল যাকে আমাদের ভাষায় বলে- কৃষ্ণের জীব, আজ এরা হয়েছে বলরামের দল । কিন্তু শুধু যন্ত্রে কোনো কাজ হয় না যন্ত্রী যদি মানুষ না হয়ে ওঠে । এদের খেতের কৃষি মনের কৃষির সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে । এখানকার শিক্ষার কাজ সজীব প্ৰণালীতে । আমি বরাবর" বলে এসেছি শিক্ষাকে জীবযাত্রার সঙ্গে মিলিয়ে চালানো উচিত । তার থেকে অবচ্ছিন্ন করে নিলে ওটা ভাণ্ডারের সামগ্ৰী হয়, পাকযন্ত্রের খাদ্য হয় না । এখানে এসে দেখলুম, এরা শিক্ষাটাকে প্ৰাণবান করে তুলেছে। তার কারণ এরা সংসারের সীমা থেকে ইস্কুলের সীমাকে সরিয়ে রাখে নি । এরা পাস করবার কিংবা পণ্ডিত করবার জন্যে শেখায় না।-- সর্বতোভাবে মানুষ করবার জন্যে শেখায় । আমাদের দেশে বিদ্যালয় আছে, কিন্তু বিদ্যার চেয়ে বুদ্ধি বড়ো, সংবাদের চেয়ে শক্তি বড়ো, পুঁথির পংক্তির বোঝার ভারে চিত্তকে চালনা করবার ক্ষমতা আমাদের থাকে না । কতবার চেষ্টা করেছি। আমাদের ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করতে, কিন্তু দেখতে পাই তাদের মনে কোনো প্রশ্নও নেই । জানতে চাওয়ার সঙ্গে জানতে পাওয়ার যে যোগ আছে সে যোগ ওদের বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে । ওরা কোনোদিন জানতে চাইতে শেখে নি- প্ৰথম থেকেই কেবলই