পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ዽbrO রবীন্দ্র-রচনাবলী বাইরের সকল কাজের উপরেও একটা জিনিস আছে যেটা আত্মার সাধনা । রাষ্টিক আর্থিক নানা গোলেমালে যখন মনটা আবিল হয়ে ওঠে তখন তাকে স্পষ্ট দেখতে পাই নে বলেই তার জোর কমে যায় । আমার মধ্যে যে বিপদ আছে, সেইজন্যেই আসল জিনিসকে আঁকড়ে ধরতে চাই । কেউ বা আমাকে উপহাস করে, কেউ বা আমার উপর রাগ করে, তাদের নিজের পথেই আমাকে টেনে নিতে চায় । কিন্তু কোথা থেকে জানি নে আমি এসেছি। এই পৃথিবীর তীর্থে, আমার পথ আমার তীর্থদেবতার বেদীর কাছে । মানুষের দেবতাকে স্বীকার করে এবং প্ৰণাম করে যাব আমার জীবনদেবতা আমাকে সেই মন্ত্র দিয়েছেন । যখন আমি সেই দেবতার নির্মাল্য ললাটে পরে যাই তখন সব জাতের লোকই আমাকে ডেকে আসন দেয়, আমার কথা মন দিয়ে শোনে। যখন ভারতবষীয়ের মুখোশ পরে দাড়াই তখন বাধা বিস্তর । যখন আমাকে এরা মানুষরূপে দেখে তখনই এরা আমাকে ভারতবর্ষীয়রূপেই শ্রদ্ধা । করে ; যখন নিছক ভারতবর্ষীয়রূপে দেখা দিতে চাই তখন এরা আমাকে মানুষরূপে সমাদর করতে পারে না । আমার স্বধৰ্ম পালন করতে গিয়ে আমার চলবার পথ ভুল-বোঝার দ্বারা বন্ধুর হয়ে ওঠে । আমার পৃথিবীর মেয়াদ সংকীর্ণ হয়ে এসেছে ; অতএব আমাকে সত্য হবার চেষ্টা করতে হবে, প্রিয় হবার নয় । আমার এখানকার খবর সত্য মিথ্যা নানাভাবে দেশে গিয়ে পৌছয় । সে সম্বন্ধে সব সময় উদাসীন থাকতে পারি। নে বলে নিজের উপর ধিককার জন্মে । বার বার মনে হয়, বানপ্রস্থের বয়সে সমাজস্থের মতো ব্যবহার করতে গেলে বিপদে পড়তে হয় । যাই হােক এ দেশের ‘এনর্মাস ডিফিকালটিজ এর কথা বইয়ে পড়েছিলুম, কানে শুনেছিলুম, কিন্তু সেই ডিফিকালটিজ অতিক্রমণের চেহারা চোখে দেখলুম। ইতি ৪ অক্টোবর ১৯৩০ GKGANR TEFRIEB আমাদের দেশে পলিটিকসকে যারা নিছক পালোয়ানি বলে জানে সব-রকম ললিতকলাকে তারা পৌরুষের বিরোধী বলে ধরে রেখেছেন । এ সম্বন্ধে আমি আগেই লিখেছি। রাশিয়ার জার ছিল একদিন দশাননের মতো সম্রাট ; তার সাম্রাজ্য পৃথিবীর অনেকখানিকেই অজগর সাপের মতো গিলে ফেলেছিল, লেজের পাকে যাকে সে জড়িয়েছে তার হাড়গোড় দিয়েছে পিষে । প্ৰায় বছর-তেরো হল এরই প্ৰতাপের সঙ্গে বিপ্লবীদের কুটােপুটি বেধে গিয়েছিল । সম্রাট যখন গুষ্টিসুদ্ধ গেল সরে তখনো তার সাঙ্গোপাঙ্গর দাপিয়ে বেড়াতে লাগল, তাদের অস্ত্র এবং উৎসাহ জোগালে অপর সাম্রাজ্যভোগীরা। বুঝতেই পািরছ ব্যাপারখানা সহজ ছিল না। একদা যারা ছিল সম্রাটের উপগ্রহ, ধনীর দল, চাষীদের পরে যাদের ছিল অসীম প্ৰভুত্ব, তাদের সর্বনাশ বেধে গেল । লুটপাট কাড়াকড়ি চলল ; তাদের বহুমূল্য ভোগের সামগ্ৰী ছারখার করবার জন্যে প্রজারা হন্যে হয়ে উঠেছে। এতবড়ো উচ্ছম্বল উৎপাতের সময় বিপ্লবী নেতাদের কাছ থেকে কড়া হুকুম এসেছে— আর্ট-সামগ্ৰীকে কোনোমতে যেন নষ্ট হতে দেওয়া না হয় । ধনীদের পরিত্যক্ত প্রাসাদ থেকে ছাত্ররা অধ্যাপকেরা অর্ধ-অভূক্ত শীতক্লিষ্ট অবস্থায় দল বেঁধে যা-কিছু রক্ষাযোগ্য জিনিস সমস্ত উদ্ধার করে য়ুনিভার্সিটির মজিয়মে সংগ্ৰহ করতে লাগল। মনে আছে আমরা যখন চীনে গিয়েছিলুম কী দেখেছিলুম। যুরোপের সাম্রাজ্যভোগীরা পিকিনের বসন্তপ্রাসাদকে কিরকম ধূলিসাৎ করে দিয়েছে, বহু যুগের অমূল্য শিল্পসামগ্ৰী কিরকম লুটে পুটে ছিড়ে ভেঙে দিয়েছে উড়িয়ে-পুড়িয়ে । তেমন সব জিনিস জগতে আর কোনোদিন তৈরি হতেই পারবে না । সোভিয়েটরা ব্যক্তিগতভাবে ধনীকে বঞ্চিত করেছে, কিন্তু যে ঐশ্বর্যে সমস্ত মানুষের চিরদিনের অধিকার, বর্বরের মতো তাকে নষ্ট হতে দেয় নি । এতদিন যারা পরের ভোগের জন্যে জমি চাষ করে