পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি ○ ケ> এসেছে এরা তাদের যে কেবল জমির স্বত্ব দিয়েছে তা নয় ; জ্ঞানের জন্যে, আনন্দের জন্যে, মানবজীবনের যা-কিছু মূল্যবান সমস্ত তাদের দিতে চেয়েছে ; শুধু পেটের ভাত পশুর পক্ষে যথেষ্ট, মানুষের পক্ষে নয়- এ কথা তারা বুঝেছিল এবং প্রকৃত মনুষ্যত্বের পক্ষে পালোয়ানির চেয়ে আর্টের অনুশীলন অনেক বড়ো এ কথা তারা স্বীকার করেছে। এদের বিপ্লবের সময় উপরিতলার অনেক জিনিস নীচে তলিয়ে গেছে। এ কথা সত্য, কিন্তু টিকে রয়েছে এবং ভরে উঠেছে ম্যুজিয়াম থিয়েটর লাইব্রেরি সংগীতশালা । , আমাদের দেশের মতোই একদা এদের গুণীর গুণাপনা প্ৰধানত ধর্মমন্দিরেই প্ৰকাশ পেত । মোহন্তেরা নিজের স্থূল রুচি নিয়ে তার উপরে যেমন-খুশি হাত চালিয়েছে। আধুনিক শিক্ষিত ভক্ত বাবুরা পুরীর মন্দিরকে যেমন চুনকাম করতে সংকুচিত হয় নি, তেমনি এখানকার মন্দিরের কর্তারা আপন সংস্কার -অনুসারে সংস্কৃত করে প্রাচীন কীর্তিকে অবাধে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে— তার ঐতিহাসিক মূল্য যে সর্বজনের সর্বকালের পক্ষে এ কথা তারা মনে করে নি, এমন-কি, পুরোনো পুজোর পাত্রগুলিকে নূতন করে ঢালাই করেছে । আমাদের দেশেও মঠে মন্দিরে অনেক জিনিস আছে, ইতিহাসের পক্ষে যা মূল্যবান । কিন্তু কারও তা ব্যবহার করবার জো নেই- মোহন্তেরাও অতলস্পর্শ মোহে মগ্ন— সেগুলিকে ব্যবহার করবার মতো বুদ্ধি ও বিদ্যার ধার ধারে না ; ক্ষিতিবাবুর কাছে শোনা যায়, প্ৰাচীন অনেক পুঁথি মঠে। মঠে আটক পড়ে আছে, দৈত্যপুরীতে রাজকন্যার মতো, উদ্ধার করবার উপায় নেই । বিপ্লবীরা ধর্মমন্দিরে সম্পত্তির বেড়া ভেঙে দিয়ে সমস্তকেই সাধারণের সম্পত্তি করে দিয়েছে । যেগুলি পূজার সামগ্ৰী সেগুলি রেখে বাকি সমস্ত জমা করা হচ্ছে মজিয়মে। এক দিকে যখন আত্মবিপ্লব চলছে, যখন চার দিকে টাইফয়িডের প্রবল প্ৰকোপ, রেলের পথ সব উৎখাত, সেই সময়ে বৈজ্ঞানিক সন্ধানীর দল গিয়েছে প্ৰত্যন্তপ্রদেশ সমস্ত হাতড়িয়ে পুরাকালীন শিল্পসামগ্ৰী উদ্ধার করবার জন্যে । কত পুঁথি কত ছবি কত খোদকারির কাজ সংগ্ৰহ হল তার সীমা নেই । এ তো গেল ধনীগৃহে বা ধর্মমন্দিরে যা-কিছু পাওয়া গেছে তারই কথা । দেশের সাধারণ চাষীদের কমিকদের কৃত শিল্পসামগ্ৰী, পূর্বতন কালে যা অবজ্ঞাভাজন ছিল তার মূল্য নিরূপণ করবার দিকেও দৃষ্টি পড়েছে । শুধু ছবি নয়, লোকসাহিত্য লোকসংগীত প্ৰভৃতি নিয়েও প্রবলবেগে কাজ চলছে। এই তো গেল সংগ্ৰহ, তার পরে এই সমস্ত সংগ্ৰহ নিয়ে লোকশিক্ষার ব্যবস্থা । ইতিপূর্বেই তার বিবরণ লিখেছি । এত কথা যে তোমাকে লিখছি তার কারণ এই দেশের লোককে আমি জানাতে চাই, আজ কেবলমাত্র দশ বছরের আগেকার রাশিয়ার জনসাধারণ আমাদের বর্তমান জনসাধারণের সমতুল্যই ছিল ; সোভিয়েট শাসনে এইজাতীয় লোককেই শিক্ষার দ্বারা মানুষ করে তোলবার আদর্শ কতখানি উচ্চ । এর মধ্যে বিজ্ঞান সাহিত্য সংগীত চিত্ৰকলা সমস্তই আছে- অর্থাৎ আমাদের দেশের ভদ্রনামধারীদের জন্যে শিক্ষার যে আয়োজন তার চেয়ে অনেক গুণেই সম্পূর্ণতর । কাগজে পড়লুম, সম্প্রতি দেশে প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন উপলক্ষে হুকুম পাস হয়েছে প্রজাদের কান মলে শিক্ষাকর আদায় করা, এবং আদায়ের ভার পড়েছে জমিদারের পরে । অর্থাৎ যারা অমনিতেই আধমরা হয়ে রয়েছে শিক্ষার ছুতো করে তাদেরই মার বাড়িয়ে দেওয়া । শিক্ষাকর চাই বৈকি, নইলে খরচ জোগাবে কিসে । কিন্তু দেশের মঙ্গলের জন্যে যে কার, কেন দেশের সবাই মিলে সে কর দেবে না । সিভিল সার্ভিস আছে, মিলিটারি সার্ভিস আছে, গভর্নর ভাইসরয় ও তাদের সদস্যবর্গ আছেন, কেন তাদের পরিপূর্ণ পকেটে হাত দেবার জো নেই। তারা কি এই চাষীদের অন্নোর ভাগ থেকেই বেতন নিয়ে ও পেনসন নিয়ে অবশেষে দেশে গিয়ে ভোগ করেন না । পাটকলের যে-সব বড়ো বড়ো বিলাতি মহাজন পাটের চাষীর রক্ত দিয়ে মোটা মুনফার সৃষ্টি করে দেশে রওনা করে, সেই মৃতপ্ৰায় চাষীদের শিক্ষা দেবার জন্যে তাদের কোনোই দায়িত্ব নেই ? যে-সব মিনিস্টার শিক্ষা-আইন পাস নিয়ে ভরা পেটে উৎসাহ প্ৰকাশ করেন তাদের উৎসাহের কানাকড়ি মূল্যও কি তাদের নিজের তহবিল থেকে দিতে হবে না ।