পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি @br○ বৈচিত্র্য বেশি যে, তাকে সম্পূর্ণ করে উপলব্ধি করা হন্টারের গেজেটিয়র পড়ে হতে পারে না। এক সময়ে পদব্রজে তীর্থভ্ৰমণ আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল- আমাদের তীর্থগুলিও ভারতবর্ষের সকল ংশে ছড়ানো । ভারতবর্ষকে যথাসম্ভব সমগ্রভাবে প্রত্যক্ষ অনুভব করবার এই ছিল উপায় । শুধুমাত্র শিক্ষাকে লক্ষ্য করে। পাচ বছর ধরে ছাত্রদের যদি সমস্ত ভারতবর্ষ ঘুরিয়ে নেওয়া যায় তা হলে তাদের শিক্ষা পাকা হয় । p মন যখন সচল থাকে সে তখন শিক্ষার বিষয়কে সহজে গ্রহণ ও পরিপাক করতে পারে । বাধা খোরাকের সঙ্গে সঙ্গেই ধেনুদের চরে খেতে দেওয়ারও দরকার হয়— তেমনি বাধা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গেই চ’রে শিক্ষা মনের পক্ষে অত্যাবশ্যক । আচল বিদ্যালয়ে বন্দী হয়ে আচল ক্লাসের পুঁথির খোরাকিতে মনের স্বাস্থ্য থাকে না । পুঁথির প্রয়োজন একেবারে অস্বীকার করা যায় না— জ্ঞানের বিষয় মানুষের এত বেশি যে, ক্ষেত্রে গিয়ে তাদের আহরণ করবার উপায় নেই, ভাণ্ডার থেকেই তাদের বেশির ভাগ সংগ্ৰহ করতে হয় । কিন্তু পুঁথির বিদ্যালয়কে সঙ্গে করে নিয়ে যদি প্রকৃতির বিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়ে ছাত্রদের বেড়িয়ে নিয়ে আসা যায় তা হলে কোনাে অভাব থাকে না। এ সম্বন্ধে অনেক কথা আমার মনে ছিল, আশা ছিল যদি সম্বল জোটে। তবে কোনো-এক সময়ে শিক্ষাপরিব্ৰজন চালাতে পারব | কিন্তু আমার সময়ও নেই, সম্বলিও জুটবে না । সোভিয়েট রাশিয়ায় দেখছি সর্বসাধারণের জন্য দেশভ্রমণের ব্যবস্থা ফলাও করে তুলছে। বৃহৎ এদের দেশ, বিচিত্ৰজাতীয় মানুষ তার অধিবাসী । জার-শাসনের সময়ে এদের পরস্পর দেখাসাক্ষাৎ জানাশোনা মেলামেশার সুযোগ ছিল না বললেই হয় । বলা বাহুল্য, তখন দেশভ্ৰমণ ছিল শখের জিনিস, ধনী লোকের পক্ষেই ছিল সম্ভব । সোভিয়েট আমলে সর্বসাধারণের জন্য তার উদ্যোগ । শ্রমক্লান্ত এবং রুগণ কমিকদের শ্রান্তি এবং রোগ দূর করবার জন্যে প্রথম থেকেই সোভিয়েটরা দূরে নিকটে নানা স্থানে স্বাস্থ্যনিবাস স্থাপনের চেষ্টা করেছে । আগেকার কালের বড়ো বড়ো প্ৰাসাদ তারা এই কাজে লাগিয়েছে । সে-সব জায়গায় গিয়ে বিশ্রাম এবং আরোগ্যলাভ যেমন একটা লক্ষ্য তেমনি শিক্ষালাভ আর-একটা । লোকহিতের প্রতি যাদের অনুরাগ আছে এই ভ্ৰমণ-উপলক্ষে তারা নানা স্থানে নানা লোকের আনুকল্য করবার অবকাশ পায় । জনসাধারণকে দেশভ্রমণে উৎসাহ দেওয়া এবং তার সুবিধা করে দেওয়ার জন্যে পথের মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ শিক্ষাবিতরণের উপযোগী প্ৰতিষ্ঠান খোলা হয়েছে, সেখানে পথিকদের আহারনিদ্রার ব্যবস্থা আছে, তা ছাড়া সকল-রকম দরকারি বিষয়ে তারা পরামর্শ পেতে পারে । ককেশীয় প্রদেশ ভূতত্ত্ব-আলোচনার উপযুক্ত স্থান । সেখানে এইরকম পান্থ-শিক্ষালয় থেকে ভূতত্ত্ব সম্বন্ধে বিশেষ উপদেশ পাবার আয়োজন আছে। যে-সব প্রদেশ বিশেষভাবে নৃতত্ত্ব-আলোচনার উপযোগী সে-সব জায়গায় পথিকদের জন্যে নৃতত্ত্ববিৎ উপদেশক তৈরি করে 6न्म९3शा ठूCश८छ । গ্রীষ্মের সময় হাজার হাজার ভ্ৰমণেচ্ছ আপিসে নাম রেজেষ্টি করে । মে মাস থেকে আরম্ভ করে দলে দলে নানা পথ বেয়ে প্রতিদিন যাত্রা চলে- এক-একটি দলে পচিশ-ত্রিশটি করে যাত্রী । ১৯২৮ খৃস্টাব্দে এই যাত্রীসংঘের সভ্যসংখ্যা ছিল তিন হাজারের কাছাকাছি- ২৯-এ হয়েছে বারো হাজারের উপর । এ সম্বন্ধে যুরোপের অন্যত্র বা আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করা সংগত হবে না ; সর্বদাই মনে রাখা দরকার হবে যে, রাশিয়ায় দশ বছর আগে শ্রমিকদের অবস্থা আমাদের মতোই ছিল- তারা শিক্ষা করবে, বিশ্রাম করবে, বা আরোগ্য লাভ করবে, সেজন্যে কারও কোনো খেয়াল ছিল না- আজি এরা যে-সমস্ত সুবিধা সহজেই পাচ্ছে তা আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের আশাতীত এবং ধনীদের পক্ষেও সহজ নয় । তা ছাড়া শিক্ষালাভের ধারা সমস্ত দেশ বেয়ে একসঙ্গে কত প্ৰণালীতে প্রবাহিত তা আমাদের সিবিল-সার্কিসে-পাওয়া দেশের লোকের পক্ষে ধারণা করাই কঠিন ।