পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( જે રે রবীন্দ্র-রচনাবলী উপসংহার সোভিয়েট শাসনের প্রথম পরিচয় আমার মনকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে, সে কথা পূর্বেই বলেছি । তার কয়েকটি বিশেষ কারণ আছে, সেটা আলোচনার যোগ্য । সেখানকার যে ছবিটি আমার মনের মধ্যে মূর্তি নিয়েছে তার পিছনে দুলছে ভারতবর্ষের দুৰ্গতির কালো রঙের পটভূমিকা। এই দুৰ্গতির মূলে যে ইতিহাস আছে তার থেকে একটি তত্ত্ব পাওয়া যায়, সেই তত্ত্বটিকে চিন্তা করে দেখলে আলোচ্য প্রসঙ্গে আমার মনের ভাব বোঝা সহজ হবে । রাজ্য নিয়ে যে হাত-চালাচালি হত তার গোড়ায় ছিল এই ইচ্ছা । গ্ৰীসের সেকেন্দর শাহ ধূমকেতুর -অনলোজ্বল পুচ্ছের মতো তার রণবাহিনী নিয়ে বিদেশের আকাশ বেঁটিয়ে বেড়িয়েছিলেন সে কেবল তার প্রতাপ প্রসারিত করবার জন্যে । রোমকদেরও ছিল সেই প্ৰবৃত্তি । ফিনীশীয়েরা নানা সমুদ্রের তীরে তীরে বাণিজ্য করে ফিরেছে কিন্তু তারা রাজ্য নিয়ে কাড়াকডি করে নি । একদা য়ুরোপ হতে বণিকের পণ্যতরী যখন পূর্ব-মহাদেশের ঘাটে ঘাটে পাড়ি জমালে তখন থেকে পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাসে এক নূতন পর্ব ক্রমশ অভিব্যক্তি হয়ে উঠল ; ক্ষত্ৰিযুগ গেল চলে, বৈশ্যযুগ দেখা দিল । এই যুগে বণিকের দল বিদেশে এসে তাদের পণ্যহাটের খিড়কিমহলে রাজ্য জুড়ে দিতে লাগল। প্রধানত তারা মূনাফার অঙ্ক বাড়াতে চেয়েছিল ; বীরের সম্মান তাদের লক্ষ্য ছিল না। এই কাজে তারা নানা কুটিল পস্থা অবলম্বন করতে কুষ্ঠিত হয় নি ; কারণ তারা চেয়েছিল সিদ্ধি, কীর্তি a এই সময় ভারতবর্ষ তার বিপুল ঐশ্বর্যের জন্য জগতে বিখ্যাত ছিল- তখনকার বিদেশী ঐতিহাসিকেরা সে কথা বারংবার ঘোষণা করে গেছে । এমন-কি, স্বয়ং ক্লাইভ বলে গেছেন যে, “ভারতবর্ষের ধনশালিতার কথা যখন চিন্তা করে দেখি তখন অপহরণ নৈপুণ্যে নিজের সংযমে আমি নিজেই বিস্মিত হই ।” এই প্ৰভূত ধন, এ কখনো সহজে হয় না— ভারতবর্ষ এ ধন উৎপন্ন করেছিল । তখন বিদেশ থেকে যারা এসে এখানকার রাজাসনে বসেছে তারা এ ধন ভোগ করেছে, কিন্তু নষ্ট করে নি । অর্থাৎ তারা ভোগী ছিল, কিন্তু বণিক ছিল না । তার পর বাণিজ্যের পথ সুগম করার উপলক্ষে বিদেশী বণিকেরা তাদের কারবারের গদিটার উপরে রাজত্যক্ত চড়িয়ে বসল। সময় ছিল অনুকুল । তখন মোগলরাজত্বে ভাঙন ধরেছে, মারাঠিরা শিখেরা এই সাম্রাজ্যের গ্ৰন্থিগুলো শিথিল করতে প্ৰবৃত্ত, ইংরেজের হাতে সেটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ধ্বংসের পথে । পূর্বতন রাজগীেরবলোলুপেরা যখন এ দেশে রাজত্ব করত তখন এ দেশে অত্যাচারঅবিচার-অব্যবস্থা ছিল না। এ কথা বলা চলে না । কিন্তু তারা ছিল এ দেশের অঙ্গীভূত । তাদের আঁচড়ে দেশের গায়ে যা ক্ষত হয়েছিল তা ত্বকের উপরে ; রক্তপাত অনেক হয়েছে, কিন্তু অস্থিবিন্ধনীগুলোকে নড়িয়ে দেয় নি । ধন-উৎপাদনের বিচিত্র কাজ তখন অব্যাহত চলছিল, এমন-কি, নবাব-বাদশাহের কাছ থেকে সে-সমস্ত কাজ প্রশ্রয় পেয়েছে । তা যদি না হত তা হলে এখানে বিদেশী বণিকের ভিড় ঘটবার কোনাে কারণ থাকত না— মরুভূমিতে পঙ্গপালের ভিড় জমবে কেন । তার পরে ভারতবর্ষে বাণিজ্য ও সাম্রাজ্যের অশুভ সংগমকালে বণিক রাজা দেশের ধনকাল্পতরুর শিকড়গুলোকে কী করে ছেদন করতে লাগলেন, সে ইতিহাস। শতবার-কথিত এবং অত্যন্ত শ্রুতিকটু । কিন্তু পুরাতন বলে সেটাকে বিস্মৃতির মুখঠলি চাপা দিয়ে রাখবার চেষ্টা চলবে না । এ দেশের বর্তমান দুৰ্বহ দারিদ্র্যের উপক্ৰমণিকা সেইখানে । ভারতবর্ষের ধনমহিমা ছিল, কিন্তু সেটা কোন বাহন-যোগে দ্বীপান্তরীত হয়েছে সে কথা যদি ভুলি। তবে পৃথিবীর আধুনিক ইতিহাসের একটা তত্ত্বকথা আমাদের এড়িয়ে যাবে। আধুনিক রাষ্ট্রনীতির প্রেরণাশক্তি বীর্যাভিমান নয়, সে হচ্ছে ধনের লোভ, এই তত্ত্বটি