পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি G? no Gk সভ্যতাটাকেও রক্ত দিয়ে মুছে দিয়েছে। সেই রক্তমেঘের ঝড় পশ্চিম থেকে ভিন্ন ভিন্ন দমকায় ভারতবর্ষে এসে পড়ল। তার ইতিহাস আলোচনা করা অনাবশ্যক। ধনসম্পদের স্রোত পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে ফিরাল । তার পর থেকে কুবেরের সিংহাসন পাকা হল পৃথিবীতে । বিজ্ঞান ঘোষণা করে দিলে, যন্ত্রের নিয়মই বিশ্বের নিয়ম, বাহ্য সিদ্ধি লাভের বাহিরে কোনো নিত্য সত্য নেই। প্ৰতিযোগিতার উগ্ৰতা সর্বব্যাপী হয়ে উঠল, দস্যবৃত্তি ভদ্রবেশে পেল সম্মান । লোভের প্রকাশ্য ও চোরা রাস্তা দিয়ে কারখানাঘরে, খনিতে বড়ো বড়ো আবাদে, ছদ্মনামধারী দাসবৃত্তি মিথ্যাচার ও নির্দয়তা কিরকম হিংস্র৷ হয়ে উঠেছে সে সম্বন্ধে যুরোপীয় সাহিত্যে রোমহর্ষক বৰ্ণনা বিস্তর পাওয়া যায়। পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে যারা টাকা করে আর যারা টাকা জোগায় অনেকদিন ধরে তাদের মধ্যে হাতাহাতি বেধে গেছে । মানুষের সব চেয়ে বড়ো ধর্ম সমাজধর্ম, লোভরিপু সব চেয়ে তার বড়ো হস্তারক । এই যুগে সেই রিপূ মানুষের সমাজকে আলোডিত করে তাঁর সম্বন্ধবন্ধনকে শিথিল ও বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে । এক দেশে এক জাতির মধ্যেই এই নির্মম ধনার্জন ব্যাপারে যে বিভাগ সৃষ্টি করতে উদ্যত তাতে যত । দুঃখই থাক তবু সেখানে সুযোগের ক্ষেত্র খোলা থাকে, শক্তির বৈষম্য থাকতে পারে। কিন্তু অধিকারের বাধা থাকে না । ধনের জঁাতাকলে সেখানে আজ যে আছে পেষ্যবিভাগে কাল সেই উঠতে পারে পোষণবিভাগে । শুধু তাই নয়, ধনীরা যে ধন সঞ্চয় করে, নানা আকারে সমস্ত দেশের মধ্যে তার কিছু-না-কিছু ভাগ-বাটোয়ারা। আপনিই হয়ে যায় । ব্যক্তিগত সম্পদ জাতীয় সম্পদের দায়িত্বভার অনেক পরিমাণে না নিয়ে থাকতে পারে না । লোকশিক্ষা, লোকস্বাস্থ্য, লোকরঞ্জন, সাধারণের জন্যে নানাপ্রকার হিতানুষ্ঠান- এ-সমস্তই প্ৰভূত ব্যয়সাধ্য ব্যাপার । দেশের এই সমস্ত বিচিত্ৰ দাবি ইচ্ছায় অনিচ্ছায় লক্ষ্যত অলক্ষ্যত ধনীরা মিটিয়ে থাকে । কিন্তু ভারতের যে ধানে বিদেশী বণিক বা রাজপুরুষেরা ধনী তার ন্যূনতম উচ্ছিষ্টমাত্ৰই ভারতের ভাগে পড়ে। পাটের চাষীর শিক্ষার জন্যে, স্বাস্থ্যের জন্যে সুগভীর অভাবগুলো অনাবৃষ্টির নালাডোবার মতো হী করে রইল, বিদেশগামী মুনফগ থেকে তার দিকে কিছুই ফিরল না । যা গেল তা নিঃশেষে গেল। পাটের মুনফগ সম্ভবপর করবার জন্যে গ্রামের জলাশয়গুলি দুবিত হল- এই অসহ্য জলকষ্ট নিবারণের উদ্দেশে বিদেশী মহাজনদের ভরা থলি থেকে এক পয়সা খসল না । যদি জলের ব্যবস্থা করতে হয় তবে তার সমস্ত ট্যাক্সের টান এই নিঃস্ব নিররদের রক্তের উপরই পড়ে । সাধারণকে শিক্ষা দেবার জন্যে রাজকোষে টাকা নেই- কেন নেই । তার প্রধান কারণ, প্ৰভূত পরিমাণ টাকা ভারতবর্ষকে সম্পূর্ণই ত্যাগ করে চলে যায়- এ হল লোভের টাকা, যাতে করে আপন টাকা বোলো-আনাই পর হয়ে যায়। অর্থাৎ জল উবে যায় এ পারের জলাশয়ে আর মেঘ হয়ে তার বর্ষণ হতে থাকে ও পারের দেশে । সে দেশের হাসপাতালে বিদ্যালয়ে এই হতভাগ্য অশিক্ষিত অসুস্থ মুমূৰ্ব্ব ভারতবর্ষ সুদীর্ঘকাল অপ্রত্যক্ষভাবে রসদ জুগিয়ে আসছে। দেশের লোকের দৈহিক ও মানসিক অবস্থার চরম দুঃখদৃশ্য অনেককাল স্বচক্ষে দেখে আসছি। দারিদ্র্যে মানুষ কেবল যে মরে তা নয়, নিজেকে অবজ্ঞার যোগ্য করে তোলে । তাই সার জন সাইমন বললেন যে : In our view the most formidable of the evils from which India is suffering have their roots in social and economic customs of longstanding which can only be remedied by the action of the Indian people themselves. এটা হল অবজ্ঞার কথা । ভারতের প্রয়োজনকে তিনি যে আদর্শ থেকে বিচার করছেন সেটা তাদের নিজেদের আদর্শ নয়। প্রচুর ধন-উৎপাদনের জন্যে যে অবারিত শিক্ষা, যে সুযোগ, যে স্বাধীনতা তাদের নিজেদের আছে, যে-সমস্ত সুবিধা থাকাতে র্তাদের জীবনযাত্রার আদর্শ জ্ঞানে কর্মে ভোগে নানা দিক থেকে প্ৰভূত পরিমাণে পরিপুষ্ট হতে পেরেছে, জীর্ণবস্ত্ৰ শীৰ্ণতনু রোগাক্রান্ত শিক্ষাবঞ্চিত ভারতের পক্ষে সে আদর্শ তারা কল্পনার মধ্যেই আনেন না— আমরা কোনোমতে দিনযাপন করব লোকবৃদ্ধি