পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(S\, রবীন্দ্র-রচনাবলী নিবারণ করে এবং খরচপত্র কমিয়ে, আর আজ তারা নিজের জীবিকার যে পরিস্কীত আদর্শ বহন করছেন তাকে চিরদিন বহুলপরিমাণে সম্ভব করে রাখব। আমাদের জীবিকা খর্ব করে, এর বেশি কিছু ভাববার নেই। অতএব রেমেডি’র দায়িত্ব সম্পূৰ্ণ আমাদেরই হাতে, যারা রেমেডিকে দুঃসাধ্য করে তুলেছে তাদের বিশেষ কিছু করবার নেই। মানুষ এবং বিধাতার বিরুদ্ধে এই সমস্ত নালিশ ক্ষান্ত করে রেখেই অন্তরের দিক থেকে আমাদের নিজীব পল্লীর মধ্যে প্রাণসঞ্চার করবার জন্যে আমার অতিক্ষুদ্র শক্তিকে কিছুকাল প্রয়োগ করছি। এ কাজে গবর্মেন্টের আনুকূল্য আমি উপেক্ষা করি নি, এমন-কি, ইচ্ছা করেছি। কিন্তু ফল পাই নি, তার কারণ দরদ নেই। দরদ থাকা সম্ভব নয়— আমাদের অক্ষমতা, আমাদের সকলপ্রকার দুর্দশা, আমাদের দাবিকে ক্ষীণ করে দিয়েছে। দেশের কোনো যথার্থ কৃত্যকর্মে গবর্মেন্টের সঙ্গে আমাদের কমীদের উপযুক্ত যোগসাধন অসম্ভব বলেই অবশেষে স্থির করেছি। অতএব চৌকিদারদের উদির খরচ জুগিয়ে যে-কটা কড়ি বঁাচে তাই দিয়ে যা সম্ভব তাই করা যাবে, এই রইল কথা । রাজকীয় লোভ ও তৎপ্রসূত দুর্বিষহ ঔদাসীন্যের চেহারাটা যখন মনের মধ্যে নৈরাশ্যের অন্ধকার ঘনিয়ে বসেছে এমন সময়েই রাশিয়ায় গিয়েছিলুম । যুরোপের অন্যান্য দেশে ঐশ্বর্যের আড়ম্বর যথেষ্ট দেখেছি ; সে এতই উত্তঙ্গ যে দরিদ্র দেশের ঈর্ষাও তার উচ্চ চূড়া পর্যন্ত পেঁৗছতে পারে না। রাশিয়ায় সেই ভোগের সমারোহ একেবারেই নেই, বোধ করি সেইজন্যেই তার ভিতরকার একটা রূপ দেখা সহজ ছিল । ভারতবর্ষ যার থেকে একেবারেই বঞ্চিত তারই আয়োজনকে সর্বব্যাপী করবার প্রবল প্ৰয়াস এখানে দেখতে পেলেম । বলা বাহুল্য, আমি আমার বহুদিনের ক্ষুধিত দেখার ভিতর দিয়ে সমস্তটা দেখেছি । পশ্চিম মহাদেশের অন্য কোনো স্বাধিকারসৌভাগ্যশালী দেশবাসীর চক্ষে দৃশ্যটা কিরকম ঠেকে সে কথা ঠিকমত বিচার করা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয় । অতীতকালে ভারতবর্ষের কী পরিমাণ ধন ব্রিটিশ দ্বীপে চালান গিয়েছে এবং বর্তমানে কী পরিমাণ অর্থ বর্ষে বর্ষে নানা প্ৰণালী দিয়ে সেই দিকে চলে যাচ্ছে তার অঙ্কসংখ্যা নিয়ে তর্ক করতে চাই নে । কিন্তু অতি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি এবং অনেক ইংরেজ লেখকও তা স্বীকার করেন যে, আমাদের দেশের রক্তহীন দেহে মন চাপা পড়ে গেছে, জীবনে আনন্দ নেই, আমরা অস্তরে বাহিরে মরছি— এবং তার root cause যে ভারতবাসীরই মর্মগত অপরাধের সঙ্গে জড়িত, অর্থাৎ কোনো গবমেন্টেই এর প্রতিকার করতে নিরতিশয় অক্ষম, এ অপবাদ আমরা একেবারেই স্বীকার করব না । এ কথা চিরদিনই আমার মনে ছিল যে ভারতের সঙ্গে যে পরদেশবাসী শাসনকর্তার স্বার্থের সম্বন্ধ প্রবল এবং দরদের সম্বন্ধ নেই সে গবমেন্ট নিজের গরজেই প্ৰবল শক্তিতে বিধি ও ব্যবস্থা রক্ষা করতে উৎসাহপরায়ণ ; কিন্তু যে-সকল ব্যাপারে গরজ একান্ত আমাদেরই, যেখানে আমাদের দেশকে সর্বপ্রকারে বাচিয়ে তুলতে হবে ধনে মনে ও প্রাণে, সেখানে যথোচিত পরিমাণে শক্তি প্রয়োগ করতে এ গবমেন্ট উদাসীন । অর্থাৎ এ সম্বন্ধে নিজের দেশের প্রতি শাসনকর্তাদের যত সচেষ্টতা, যত বেদনাবোধ, আমাদের দেশের প্রতি তার কিয়দংশও সম্ভব হয় না । অথচ আমাদের ধনপ্ৰাণ তাদেরই হাতে, যে উপায়ে যে উপাদানে আমরা বিনাশ থেকে রক্ষা পেতে পারি সে আমাদের হাতে নেই । এমন-কি, এ কথা যদি সত্য হয় যে, সমাজবিধি সম্বন্ধে মৃঢ়তাবশতই আমরা মরতে বসেছি। তবে এই মৃঢ়তা যে শিক্ষা, যে উৎসাহ দ্বারা দূর হতে পারে সেও ঐ বিদেশী গবমেন্টেরই রাজকোষে ও রাজমৰ্জিতে । দেশব্যাপী অশিক্ষাজনিত বিপদ দূর করবার উপায় কমিশনের পরামর্শমাত্র দ্বারা লাভ করা যায় না- সে সম্বন্ধে গবর্মেন্টের তেমনি তৎপর হওয়া উচিত। যেমন তৎপর ব্রিটিশ গবমেন্ট নিশ্চয়ই হত যদি এই সমস্যা ব্রিটেন দ্বীপের হত । সাইমন কমিশনকে আমাদের প্রশ্ন এই যে, ভারতের অজ্ঞতা-অশিক্ষার মধ্যেই এতবড়ো মৃত্যশেল নিহিত হয়ে এতদিন রক্তপাত করছে, এই কথাই যদি সত্য হয় তবে আজ একশো ষাট বৎসরের ব্রিটিশ শাসনে তার কিছুমাত্র লাঘব হল না কেন । কমিশন কি সাংখ্যতথ্যযোগে দেখিয়েছেন পুলিসের ডাণ্ডা জোগাতে ব্রিটিশরাজ যে খরচ করে থাকেন তার