পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি との> উপদেষ্টা বলেন, স্বার্থ থেকে স্ব-টাকে এক কোপে দাও উড়িয়ে, তা হলেই সমস্ত ঠিক চলবে । তাতে হয়তো উৎপাত কমতে পারে, কিন্তু চলা বন্ধ হওয়া অসম্ভব নয় । লাগাম-ছেড়া ঘোড়া গাড়িটাকে খানায় ফেলবার জো করে- ঘোড়াটাকে গুলি করে মারলেই যে তার পর থেকে গাড়িটা সুস্থভাবে চলবে, এমন চিন্তা না করে লাগামটা সম্বন্ধে চিন্তা করবার দরকার হয়ে ওঠে। দেহে দেহে পৃথক বলেই মনুষ কাড়াকড়ি হানাহানি করে থাকে, কিন্তু সব মানুষকে এক দড়িতে আষ্ট্রেপষ্ঠে বেঁধে সমস্ত পৃথিবীতে একটিমাত্র বিপুল কলেবর ঘটিয়ে তোেলবার প্রস্তাব বলগার্কিত অর্থতাত্ত্বিক কোনো জারের মুখেই শোভা পায় । বিধাতার বিধিকে একেবারে সমূলে অতিদিষ্ট করবার চেষ্টায় যে পরিমাণে সাহস তার চেয়ে অধিক পরিমাণে মৃঢ়তা দরকার করে । একদিন ভারতের সমাজটাই ছিল প্ৰধানত পল্লীসমাজ । এইরকম ঘনিষ্ঠ পল্লীসমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সঙ্গে সমাজগত সম্পত্তির সামঞ্জস্য ছিল । লোকমতের প্রভাব ছিল এমন যে, ধনী আপনার ধন সম্পূর্ণ। আপন ভোগে লাগাতে অগৌরব বোধ করত । সমাজ তার কাছ থেকে আনুকূল্য স্বীকার করেছে বলেই তাকে কতাৰ্থ করেছে, অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় যাকে চ্যারিটি বলে এর মধ্যে তা ছিল না । ধনীর স্থান ছিল সেখানেই যেখানে ছিল নির্ধন ; সেই সমাজে আপনি স্থানমর্যাদা রক্ষা করতে গেলে ধনীকে নানা পরোক্ষ আকারে বড়ো অঙ্কের খাজনা দিতে হত । গ্রামে বিশুদ্ধ জল, বৈদ্য, পণ্ডিত, দেবালয়, যাত্রা, গান, কথা, পথঘাট, সমস্তই রক্ষিত হত গ্রামের ব্যক্তিগত অর্থের সমাজমুখীন প্রবাহ থেকে, রাজকর থেকে নয় । এর মধ্যে স্বেচ্ছা এবং সমাজের ইচ্ছা দুই মিলতে পেরেছে। যেহেতু এই আদানপ্ৰদান রাষ্ট্রীয় যন্ত্রযোগে নয়, পরন্তু মানুষের ইচ্ছাবাহিত, সেইজন্যে এর মধ্যে ধর্মসাধনার ক্রিয়া চলত, অর্থাৎ এতে কেবলমাত্র আইনের চালনায় বাহ্য ফল ফলত না, অস্তরের দিকে ব্যক্তিগত উৎকর্ষসাধন হত । এই ব্যক্তিগত উৎকৰ্ষই মানবসমাজের স্থায়ী কল্যাণময় প্ৰাণবান আশ্রয় । যেহেতু তখন ধনের বিশেষ সম্মান ছিল না। এইজন্য ধন ও অধনের একটা মস্ত বিভেদ তখন ছিল অবর্তমান । ধন আপনি বৃহৎ সঞ্চায়ের দ্বারা নয়, আপন মহৎ দায়িত্ব পূরণ করে তবে সমাজে মর্যাদা লাভ করত ; নইলে তার ছিল লজা । অর্থাৎ সম্মান ছিল ধর্মের, ধনের নয় । এই সম্মান সমাপণ করতে গিয়ে কারও আত্মসম্মানের হানি হত না । এখন সেদিন গেছে বলেই সামাজিক-দায়িত্বহীন ধনের প্রতি একটা অসহিষ্ণুতার লক্ষণ নানা আকারে দেখা যাচ্ছে। কারণ, ধন এখন মানুষকে অর্ঘ্য দেয় না, তাকে অপমানিত করে । যুরোপীয় সভ্যতা প্ৰথম থেকেই নগরে সংহত হবার পথ খুঁজেছে । নগরে মানুষের সুযোগ হয় বড়ো, সম্বন্ধ হয় খাটাে । নগর অতিবৃহৎ মানুষ সেখানে বিক্ষিপ্ত, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য একান্ত, প্রতিযোগিতার মথন প্রবল। ঐশ্বৰ্য সেখানে ধনী-নির্ধনের বিভাগকে বাড়িয়ে তোলে এবং চ্যারিটির দ্বারা যেটুকু যোগসাধন হয় তাতে সাত্মনা নেই, সম্মান নেই । সেখানে যারা ধনের অধিকারী এবং যারা ধনের বাহন তাদের মধ্যে আর্থিক যোগ আছে, সামাজিক সম্বন্ধ বিকৃত অথবা বিচ্ছিন্ন । এমন অবস্থায় যন্ত্রযুগ এল, লাভের অঙ্ক বেড়ে চলল অসম্ভব পরিমাণে । এই লাভের মহামারী সমস্ত পৃথিবীতে যখন ছড়াতে লাগল। তখন যারা দূরবাসী অনামীয়, যারা নির্ধন, তাদের আর উপায় রইল না- চীনকে খেতে হল আফিম ; ভারতকে উজাড় করতে হল। তার নিজস্ব ; আফ্রিকা চিরদিন পীড়িত, তার পীড়া বেড়ে চলল। এ তো গেল বাইরের কথা, পশ্চিম মহাদেশের ভিতরেও ধনী নির্ধনের বিভাগ আজ অত্যন্ত কঠোর ; জীবনযাত্রার আদর্শ বহুমূল্য ও উপকরণবহুল হওয়াতে দুই পক্ষের ভেদ অত্যন্ত প্ৰবল হয়ে চোখে পড়ে । সাবেক কালে, অন্তত আমাদের দেশে, ঐশ্বর্যের আড়ম্বর ছিল প্ৰধানত সামাজিক দানে ও কর্মে, এখন হয়েছে ব্যক্তিগত ভোগে । তাতে বিস্মিত করে, আনন্দিত করে না ; ঈর্ষা জাগায়, প্ৰশংসা জাগায় না । সব চেয়ে বড়ো কথাটা হচ্ছে এই যে, তখন সমাজে ধনের ব্যবহার একমাত্র দাতার স্বেচ্ছার উপর নির্ভর করত না, তার উপরে ছিল সামাজিক ইচ্ছার প্রবল প্রভাব । সুতরাং দাতাকে নম্র হয়ে দান করতে হত ; “শ্রদ্ধয়া দেয়ং এই কথাটা খাটত ।