পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি やのお বসে থাকতে পারে । বড়ো বড়ো হিসাবের খাতা ছাড়া তাঁর আর কিছু নেই, তার সঙ্গে কারো সম্বন্ধ নেই । আপনার টাকার গড়খাই করে তার মধ্যে সে বসে আছে, সর্বসাধারণের সঙ্গে তার সম্বন্ধ কোথায় । এখনকার সঙ্গে তুলনা করলে অনেক অভাব আমাদের দেশে ছিল । এখন আমরা কলের জল খাই, তাতে রোগের বীজ কম ; ভালো ডাক্তার পাই, ডাক্তারয়ানা আছে ; জ্ঞানবিজ্ঞানের সাহায্যে অনেক সুযোগ ঘটেছে । আমি তাকে অসম্মান করি নে ; কিন্তু আমাদের খুব একটা বড়ো সম্পদ ছিল, সে হচ্ছে আত্মীয়তা । এর চেয়ে বড়ো সম্পদ নেই। এই আত্মীয়তার যেখানে অভাব সেখানে সুখশান্তি থাকতে পারে না । * সমস্ত পশ্চিম মহাদেশে মানুষে মানুষে আত্মীয়তা অত্যন্ত ভাসা-ভাসা । তার গভীর শিকড় নেই। সকলে বলছে, “আমি ভোগ করব, আমি বড়ো হব, আমার নাম হবে, আমার মুনাফা হবে ।” যে তা করছে তার কতবড়ো সম্মান । তার ধনশক্তির পরিমাপ করতে গিয়ে সেখানকার লোকের মন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে । ব্যক্তিগত শক্তির এইরকম উপাসনা এমনভাবে আমাদের দেশে দেখি নি । কিছু না, একটা লোক শুধু ঘুষি চালাতে পারে । সে ঘুষির বড়ো ওস্তাদ রাস্তা দিয়ে বেরোল, রাস্তায় ভিড় জমে গেল । খবর এল সিনেমার নটী লণ্ডনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে আসছে, গাড়ির ভিতর থেকে চকিতে তাকে দেখবে বলে জনতায় রাস্তা নিরেট হয়ে উঠল । আমাদের দেশে মহদাশয় যাকে বলি তিনি এলে আমরা সকলে তার চরণাধুলো নেব । মহাত্মা গান্ধী যদি আসেন দেশসুদ্ধ লোক খেপে যাবে । তার না আছে অর্থ, না আছে বাহুবল, কিন্তু আছে হৃদয়, আছে আধ্যাত্মিক শক্তি । আমি যতদূর জানি তিনি ঘুষি মারতে জানেন না, কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে তিনি বড়ো করে স্বীকার করেছেন ; আপনাকে তিনি স্বতন্ত্র করে রাখেন নি, তিনি আমাদের সকলের, আমরা সকলে তার । ব্যস, হয়ে গেল, এর চেয়ে বেশি আমরা কিছু বুঝি নে । তার চেয়ে অনেক বিদ্বান, অনেক জ্ঞানী, অনেক ধনী আছে ; কিন্তু আমাদের দেশ দেখবে আত্মদানের ঐশ্বৰ্য । এ কি কম কথা ! এর থেকে বুঝি, আমাদের দেশের লোক কী চায় । পাণ্ডিত্য নয়, ঐশ্বৰ্য নয়, আর কিছু নয়, চায় মানুষের আত্মার সম্পদ । কিন্তু দিনে দিনে পরিবর্তন হয়ে এসেছে । আমি গ্রামে অনেকদিন কাটিয়েছি, কোনোরকম চাটুবাক্য বলতে চাই নে । গ্রামের যে মূর্তি দেখেছি সে অতি কুৎসিত। পরস্পরের মধ্যে ঈর্ষা বিদ্বেষ ছলনা, বঞ্চনা বিচিত্র আকারে প্রকাশ পায় । মিথ্যা মকদ্দমায় সাংঘাতিক জালে পরস্পরকে জড়িয়ে মারে । সেখানে দুনীতি কতদূর শিকড় গেড়েছে তা চক্ষে দেখেছি। শহরে কতকগুলি সুবিধা আছে, গ্রামে তা নেই ; গ্রামের যেটা আপন জিনিস ছিল তাও আজ সে হারিয়েছে । মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা নিয়ে আজ এসেছি। গ্রামবাসী তোমাদের কাছে। পূর্বে তোমরা সমাজবন্ধনে এক ছিলে, আজ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পরস্পরকে কেবল আঘাত করছি । আর-একবার সম্মিলিত হয়ে তোমাদের শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে । বাহিরের আনুকূল্যের অপেক্ষা কোরো না । শক্তি তোমাদের মধ্যে আছে জেনেই সেই শক্তির আত্মবিস্মৃতি আমরা ঘোচাতে ইচ্ছা করেছি । কেননা তোমাদের সেই শক্তির উপর সমস্ত দেশের দাবি আছে । ভিত যতই যাচ্ছে কবসে উপরের তলায় ফাটল ধরছে- বাইরে থেকে পলস্তারা দিয়ে বেশি দিন তাকে বাচিয়ে রাখা চলবে না । এসো তোমরা, প্রার্থীভাবে নয়, কৃতীভাবে । আমাদের সহযোগী হও, তা হলেই সার্থক হবে আমাদের এই উদ্যোগ । গ্রামের সামাজিক প্ৰাণ সুস্থ হয়ে সবল হয়ে উঠক । গানে গীতে কাব্যে কথায় অনুষ্ঠানে আনন্দে শিক্ষায় দীক্ষায় চিত্ত জাশুক । তোমাদের দৈন্য দুর্বলতা আত্মাবমাননা ভারতবর্ষের বুকের উপর প্রকাণ্ড বোঝা হয়ে চেপে রয়েছে। আর-সকল দেশ এগিয়ে চলেছে, আমরা অজ্ঞানে অশিক্ষায় স্থাবর হয়ে পড়ে আছি। এ সমস্তই দূর হয়ে যাবে। যদি নিজের শক্তিসম্বলকে সমবেত করতে পারি । আমাদের এই শ্ৰীনিকেতনে জনসাধারণের সেই শক্তিসমবায়ের সাধনা ৷ S Sve'A