পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম পথ চলেছিল একটানা বাইরের দিকে, তার নিজের মধ্যে নিজের অর্থ ছিল না । পীেছল এসে ঘরে, সেখানে অর্থ পাওয়া গেল, আরম্ভ হল ভিতরের লীলা । মানুষে এসে পৌঁছল সৃষ্টিব্যাপার, কর্মবিধির পরিবর্তন ঘটল, অস্তরের দিকে বইল তার ধারা । অভিব্যক্তি চলছিল প্ৰধানত প্ৰাণীদের দেহকে নিয়ে, মানুষে এসে সেই প্রক্রিয়ার সমস্ত ঝোক পড়ল মনের দিকে । পূর্বের থেকে মস্ত একটা পার্থক্য দেখা গেল । দেহে দেহে জীব স্বতন্ত্র ; পৃথকভাবে আপন দেহরক্ষায় প্ৰবৃত্ত, তা নিয়ে প্রবল প্ৰতিযোগিতা । মনে মনে সে আপনার মিল পায় এবং মিল চায়, মিল না পেলে সে অকৃতাৰ্থ । তার সফলতা সহযোগিতায় । বুঝতে পারে, বহুর মধ্যে সে এক ; জানে, তার নিজের মনের জানাকে বিশ্বমানবমন যাচাই করে, প্রমাণিত করে, তবে তার মূল্য । দেখতে পায়, জ্ঞানে কর্মে ভাবে যতই সকলের সঙ্গে সে যুক্ত হয় ততই সে সত্য হয় । যোগের এই পূর্ণতা নিয়েই মানুষের সভ্যতা । তাই মানুষের সেই প্রকাশই শ্রেষ্ঠ যা একান্ত ব্যক্তিগত মনের নয়, যাকে সকল কালের সকল মানুষের মন স্বীকার করতে পারে । বুদ্ধির বর্বরতা তাকেই বলে যা এমন মতকে, এমন কর্মকে, সৃষ্টি করে যাতে বৃহৎকালে সর্বজনীন মন আপনার সায় পায় না । এই সর্বজনীন মনকে উত্তরোত্তর বিশুদ্ধ করে উপলব্ধি করাতেই মানুষের অভিব্যক্তির উৎকর্ষ | মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎ মানুষের সাধনা । এই ; বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ । রাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অস্তরে আছে এক মানব । ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অস্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অস্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌচেছে বিশ্বমানসলোকে । যে লোকে তার বাণী, তার শ্ৰী, তার মুক্তি । সফলতালাভের জন্যে সে মন্ত্রতন্ত্র ক্রিয়াকর্ম নিয়ে বাহ্য পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হয়েছিল ; অবশেষে সার্থকতালাভের জন্যে একদিন সে বললে, তপস্যা বাহ্যানুষ্ঠানে নয়, সত্যই তপস্যা ; গীতার ভাষায় ঘোষণা করলে, দ্রব্যময় যজ্ঞের চেয়ে জ্ঞানযজ্ঞই শ্রেয় ; খুস্টের বাণীতে শুনলে, বাহ্য বিধিনিষেধে পবিত্রতা নয়, পবিত্রতা চিত্তের নির্মলতায় । তখন মানবের রুদ্ধ মনে বিশ্বমানবচিত্তের উদবোধন হল । এই তার অন্তর সত্তার বোধ দৈহিক সত্তার ভেদসীমা ছাড়িয়ে দেশে কালে সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যের দিকে প্রসারিত । এই বোধেরই শেষ কথা এই যে, যে মানুষ আপনার আত্মার মধ্যে অন্যের আত্মাকে ও অন্যের আত্মার মধ্যে আপনার আত্মাকে জানে। সেই জানে সত্যকে । মানুষ আছে তার দুই ভাবকে নিয়ে, একটা তার জীবভাব, আর-একটা বিশ্বভাব। জীব আছে আপনি উপস্থিতকে আঁকড়ে, জীব চলছে। আশু প্রয়োজনের কেন্দ্ৰ প্ৰদক্ষিণ করে । মানুষের মধ্যে সেই জীবকে পেরিয়ে গেছে যে সত্তা সে আছে আদর্শকে নিয়ে । এই আদর্শ অন্নের মতো নয়, বস্ত্রের মতো নয় । এ আদর্শ একটা আন্তরিক আহবান, এ আদর্শ একটা নিগৃঢ় নির্দেশ । কোন দিকে নির্দেশ । যে দিকে সে বিচ্ছিন্ন নয়, যে দিকে তার পূর্ণতা, যে দিকে ব্যক্তিগত সীমাকে সে ছাড়িয়ে চলেছে, যে দিকে বিশ্বমানব । ঋগবেদে সেই বিশ্বমানবের কথা বলেছেন ; পাদোহাস্য বিশ্বা ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি— তার এক চতুথাংশ আছে জীবজগতে, তার বাকি বৃহৎ অংশ উর্ধে অমৃতরূপে । মানুষ যে দিকে সেই ক্ষুদ্র অংশগত আপনার উপস্থিতিকে, প্রত্যক্ষকে, অতিক্রম করে সত্য সেই দিকে, সে মৃত্যুহীন ;