পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম MSv) গাড়ির সীমার মধ্যে তার আহারবিহারের সন্ধান চলছে নীচের দিকে ঝুকে । ঐটুকুর মধ্যে বাধাবিপত্তি যথেষ্ট । তাই নিয়ে দিন কাটে। মানুষের মতো সে মাথা তুলে উঠে দাড়াতে পারে না। উপরের জানলা পর্যন্ত পৌছয় না। তার দৃষ্টি, তার মনের গতি নেই প্ৰাণধারণের বাইরে । মানুষ খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে । সামনে পেয়েছে জানলা । জানতে পেরেছে, গাড়ির মধ্যেই সব-কিছু বদ্ধ নয় । তার বাইরে দিগন্তের পর দিগন্ত । জীবনের আশু লক্ষ্যপথ উত্তীর্ণ হয়েও যা বাকি আছে তার আভাস পাওয়া যায়, সীমা দেখা যায় না । যেটুকু আলো গাড়ির প্রয়োজনের পক্ষে যথোপযুক্ত, বাইরে তারই বিস্তার অবাধ অজস্ৰ । সেই আলো তাকে ডাকে কেন । ঐ প্রয়োজনাতীত প্ৰাণীর ; কিন্তু মানুষকে অস্থির করে তুললে যে । বললে, তাকে ছাড়া পেতে হবে সেইখানেই যেখানে তার প্রয়োজন নেই, যার পরিচয় তার কাছে আজও অসম্পূর্ণ। প্রাণশক্তির অতিনির্দিষ্ট সাম্রাজ্যপ্রাচীর লঙঘন করে সে জয় করতে বেরোল আপনি স্বরাজ । এই জয়যাত্রার পথে তার সহজ প্ৰবৃত্তি তার পক্ষ নেয় না, এই পথে তার আরাম নেই, তার বিশ্রাম নেই ; শত শত যাত্রী প্ৰাণ দিয়ে এই পথকে কেবলই প্রশস্ত করছে, উন্মুক্ত করছে ! r দেহের দিকে মানুষকে বিচার করে দেখা যাক ; সে উঠে দাড়িয়েছে । এমন কথা বলা চলে না যে, দাড়াবে না তো কী ! দাঁড়ানাে সহজ নয় ; পাখির দেহের ছন্দটা দ্বিপদী । মানুষের দেহটা চতুষ্পদ জীবের প্রশস্ত ছন্দে বানানো । চার পায়ের উপর লম্বা দেহের ওজন সামনে পিছনে ভাগ করে দিলেই এমনতরো দেহটাকে একসঙ্গে বহন ও সঞ্চালন তার পক্ষে সহজ হতে পারত । কিন্তু মানুষ আপন দেহের স্বভাবকে মানতে চাইলে না, এজন্যে সে অসুবিধে সইতেও রাজি । চলমান দীর্ঘ দেহটার ভাররক্ষার সাধনা করলে ঐ দুই পায়ের উপরেই ! সেটা সহজসাধ্য নয়, ছেলেদের প্রথম চলার অভ্যাস দেখলেই তা বোঝা যায় । শেষ বয়সে বুদ্ধকে লাঠির উপর ভর দিতে হয়, সেও একটা প্ৰমাণ । এও দেখা যায়, চার- পেয়ে জন্তু যত সহজে ভার বহন করতে পারে মানুষ তা পারে না- এইজন্যেই অন্যের পরে নিজের বোঝা চাপাবার নানা কৌশল মানুষের অভ্যস্ত । সেই সুযোগ পেয়েছে বলেই যত পেরেছে ভার-সৃষ্টি করেছে । তাকে পরিমিত করবার চেষ্টা নেই । মানুষের এই চালটা যে সহজ নয় তাৱ দৃষ্টান্ত প্ৰায়ই পাওয়া যায় । ধাক্কা খেয়ে মানুষের অঙ্গহানি বা গাম্ভীর্যহানির যে আশঙ্কা, জন্তুদের সেটা নেই । শুধু তাই নয়, ডাক্তারের কাছে শোনা যায় মানুষ উত্ততভঙ্গি নিয়েছে বলে তার আদিম অবতত দেহের অনেক যন্ত্রকে রোগদুঃখ ভোগ করতে হয় । তবু মানুষ স্পর্ধা করে উঠে দাড়ালো । নীচের দিকে ঝুকে পড়ে জন্তু দেখতে পায় খণ্ড খণ্ড বস্তুকে । তার দেখার সঙ্গে তার ব্ৰাণ দেয় যোগ । চোখের দেখাটা অপেক্ষাকৃত অনাসক্ত, জ্ঞানের রাজ্যে তার প্রভাব বেশি । ঘাণের অনুভূতি দেহবৃত্তির সংকীর্ণ সীমায় । দেখা ও ঘাণ নিয়ে জন্তুরা বস্তুর যে পরিচয় পায় সে পরিচয় বিশেষভাবে আশু প্রয়োজনের । উপরে মাথা তুলে মানুষ দেখলে কেবল বস্তুকে নয়, দেখলে দৃশ্যকে অর্থাৎ বিচিত্র বস্তুর ঐক্যকে । একটি অখণ্ড বিস্তারে কেন্দ্ৰস্থলে দেখলে নিজেকে । একে বলা যায় মুক্তদৃষ্টি । খাড়া-হওয়া মানুষের কাছে নিকটের চেয়ে দূরের দাম বেশি । অজ্ঞাত অভাবনীয়ের দিকে তার মন হয়েছে প্ৰবৃত্ত । এই দৃষ্টির সঙ্গে যোগ দিয়েছে। অন্তরের কল্পনা দৃষ্টি । শুধু দৃষ্টি নয়, সঙ্গে সঙ্গে দুটাে হাতও পেয়েছে মুক্তি | পায়ের কাজ থেকে হাত যদি ছুটি না পেত তা হলে সে থাকত দেহেরই একান্ত অনুগত, চতুর্থ বর্ণের মতো অস্পশ্যতার মলিনতা নিয়ে । পুরাণে বলে, ব্ৰহ্মার পায়ের থেকে শূদ্ৰ ख्ला छ, कधिग्र शठन (थक । মানুষের দেহে শূদ্রের পদোন্নতি হল ক্ষাত্রধর্মে, পেল সে হাতের গৌরব, তখন মনের সঙ্গে হল তার মৈত্রী । মানুষের কল্পনাবৃত্তি হাতকে পেয়ে বসল। দেহের জরুরি কাজগুলো সেরে দিয়েই সে লেগে । গেল নানা বাজে কাজে ।াজীবনযাত্রার কর্মব্যবস্থায় সে whole-time কর্মচারী রইল না । সে লাগল। অভাবিতের পরীক্ষায়, অচিন্ত্যপূর্বের রচনা- অনেকটাই অনাবশ্যক । মানুষের ঋজু মুক্ত দেহ মাটির 'নিকটস্থ টান ছাড়িয়ে যেতেই তার মন এমন একটা বিরাট রাজ্যের পরিচয় পেলে যা অল্পৱক্ষের নয়,