পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

vo SR 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী যাকে বলা যায় বিজ্ঞানব্রহ্মের, আনন্দব্ৰহ্মের রাজ্য । এ রাজ্যে মানুষ যে কাজগুলো করে হিসাবি লোক জিজ্ঞাসা করতে পারে, “এ-সব কেন।” একমাত্র তার উত্তর, “আমার খুশি ।” তার বিজ্ঞানে, তার সাহিতো, তার শিল্পকলায় এই এক উত্তর “আমার খুশি” । মাথাতোলা মানুষের এতবড়ো গৰ্ব্ব । জন্তুদেরও যথেচ্ছ খেলার অবকাশ আছে, কিন্তু জীবনে তাদের খেলাটা গৌণ। তা ছাড়া তাদের খেলাও প্রকৃতির অনুগত । বিড়ালছানার খেলা মিথ্যা ইদুর মিছামিছি ধরা, কুকুর-ছানার খেলা নিজের লেজের সঙ্গে লড়াই করার সগর্জন ভান । কিন্তু, মানুষের যে কাজটাকে লীলা বলা যায় অর্থাৎ যা তার কোনো দরকারের আমলে আসে না, কথায় কথায় সেইটেই হয়ে ওঠে মুখ্য, ছাড়িয়ে যায় তার প্ৰাণ যাত্রাকে । সেইটের দ্বারাই তার শ্রেষ্ঠতার পরিচয় । অবকাশের ভূমিকায় মানুষ সর্বত্রই আপন অমরাবতী-রচনায় ব্যস্ত, সেখানে তার আকাশকুসুমের কুঞ্জবন । এই-সব কাজে সে এত গৌরব বোধ করে যে চাষের খেতে তার অবজ্ঞা । আধুনিক বাংলাভাষায় সে যাকে একটা কুশ্রাব্য নাম দিয়েছে কৃষ্টি, বাহুল্য, দূরতম তারায় মানুষের নূ্যনতম প্রয়ােজন, সেই তারার যে আলোকরশ্মি চার-পাচ হাজার এবং ততোধিক বৎসর ধরে ব্যোমবিহারী, গহত্যাগী, তারই দৌড় মাপতে মানুষের দিন যায়, তার রাত কাটে । তা ছাড়া মানুষ অকারণে কথার সঙ্গে কথার বিনুনি করে কবিতাও লেখে ; এমন-কি, যারা আধাপেটা খেয়ে কুশতনু তারাও বাহবা দেয় । এর থেকেই আন্দাজ করি, মানুষের অন্নের খেত প্ৰকৃতির এলেকায় থাকতে পারে, দেহের দ্বারে পেয়াদার তাগিদে তার খাজনাও দিতে হয়, কিন্তু যেখানে নেই, সেখানে সকলের চেয়ে বড়ো দায়িত্ব স্বাধীন দায়িত্ব ; তাকে বলব আদর্শের দায়িত্ব, মনুষ্যত্বের, দায়িত্ব । দেহের দিক থেকে মানুষ যেমন উধ্বশিরে নিজেকে টেনে তুলেছে খণ্ডভূমির থেকে বিশ্বভূমির দিকে, নিজের জানাশোনাকেও তেমনি স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে জৈবিক প্রয়োজন থেকে, ব্যক্তিগত অভিরুচির থেকে । জ্ঞানের এই সম্মানে মানুষের বৈষয়িক লাভ হােক বা না হােক, আনন্দলাভ হল । এইটেই বিস্ময়ের কথা । পেট না ভরিয়েও কেন হয় আনন্দ । বিষয়কে বড়ো করে পায় বলে আনন্দ নয়, আপনাকেই বড়ো করে, সত্য করে পায় বলে আনন্দ । মানবজীবনের যে বিভাগ অহৈতুক অনুরাগের অর্থাৎ আপনার বাহিরের সঙ্গে অন্তরঙ্গ যোগের, তার পুরস্কার আপনারই মধ্যে । কারণ, সেই যোগের প্ৰসারেই আত্মার সত্য । ন বা অরে পুত্ৰস্য কামায় পুত্ৰঃ প্রিয়োভবতি, আত্মনস্তু কামায় পুত্র প্রিয়োভবতি । জীবলোকে চৈতন্যের নীহারিকা অস্পষ্ট আলোকে ব্যাপ্ত । সেই নীহারিকা মানুষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে উজ্জ্বল দীপ্তিতে বললে, “অয়মহং ভোঃ ! এই-যে আমি।” সেই দিন থেকে মানুষের ইতিহাসে নানা ভাবে নানা রূপে নানা ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া চলল, “আমি কী” । ঠিক উত্তরটিতে তার আনন্দ, তার গৌরব । জন্তুর উত্তর পাওয়া যায়। তার দৈহিক ব্যবস্থার যথাযোগ্যতায় । সনাতন গণ্ডারের মতো স্থূল ব্যবহারে গণ্ডার যদি কোনো বাহ্য বাধা না পায় তা হলে আপনি সার্থক্য সম্বন্ধে তার কোনো সংশয় থাকে না । কিন্তু, মানুষ কী করে হবে মানুষের মতো তাই নিয়ে বর্বরাদশা থেকে সভ্য অবস্থা পর্যন্ত তার চিন্তা ও প্রয়াসের অন্ত নেই। সে বুঝেছে, সে সহজ নয়, তার মধ্যে একটা রহস্য আছে ; এই রহস্যের আবরণ উদঘাটিত হতে হতে তবে সে আপনাকে চিনবে । শত শত শতাব্দী ধরে চলেছে। তার প্রয়াস । কত ধৰ্মতন্ত্র, কত অনুষ্ঠানের পত্তন হল ; সহজ প্রবৃত্তির প্রতিবাদ করে নিজেকে সে স্বীকার করাতে চায় যে, বাইরে সে যা ভিতরে ভিতরে তার চেয়ে সে বড়ো । এমন কোনো সত্তার স্বরূপকে সে মনের মধ্যে গ্ৰহণ করবার চেষ্টা করছে, আদর্শরূপে যিনি তার চেয়ে বড়ো অথচ তার সঙ্গে চিরসম্বন্ধযুক্ত । এমনি করে বড়ো ভূমিকায় নিজের সত্যকে স্পষ্ট করে উপলব্ধি করতে তার অহৈতুক আগ্ৰহ । যাকে সে পূজা করে তার দ্বারাই সে প্রমাণ করে তার মতে নিজে সে সত্য কিসে, তার বুদ্ধি । কাকে বলে পূজনীয়, কাকে জানে পূর্ণতা বলে। সেইখনেই আপন দেবতার নামে মানুষ উত্তর দিতে |