পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SSRVe রবীন্দ্র-রচনাবলী নিজেকে সত্যতাররূপে অনুভব করে বলেই তার প্রত্যক্ষ বর্তমানকে বিসর্জন দেওয়া সে ক্ষতি মনে করে না । ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি । পূর্ণ পুরুষের অধিকাংশ এখনো আছে অব্যক্ত । তাকেই ব্যক্ত করবার প্রত্যাশা নিয়ত চলেছে। ভবিষ্যতের দিকে । পূৰ্ণ পুরুষ আগন্তক । তার রথ ধাবমান, কিন্তু তিনি এখনো এসে পীেছন নি। বরযাত্রীরা আসছে, যুগের পর যুগ অপেক্ষা করছে, বরের বাজনা আসছে। দূর থেকে । তাকে এগিয়ে নিয়ে আসবার জন্যে দূতেরা চলেছে দুৰ্গম পথে । এই-যে অনিশ্চিত আগামীর । দিকে মানুষের এত প্ৰাণপণ আগ্ৰহ- এই-যে অনিশ্চিতের মধ্যে, অনাগতের মধ্যে তার চিরনিশ্চিতের সন্ধান অক্লান্ত— তারই সংকটসংকুল পথে মানুষ বার বার বাধা পেয়ে ব্যর্থ হয়েও যাত্রা বন্ধ করতে পারলে না । এই অধ্যবসায়কে বলা যেতে পারত পাগলামি, কিন্তু মানুষ তাকেই বলেছে মহত্ত্ব । এই মহন্ধের আশ্রয় কোথায় । অলক্ষ্য একটা পরিপূর্ণতার দিকে মানুষের মনের আকর্ষণ দেখতে পাই ; অন্ধকার ঘরের গাছে, তার শাখায় প্রশাখায়, যেমন একটা স্বাভাবিক ব্যাকুলতা প্রাচীরের ও—পারের আলোকের দিকে । আলোক যেমন সত্য, পূর্ণের আকর্ষণ নিয়ত যেখান থেকে প্রেরিত সেও যদি তেমনি সত্য না হত তা হলে জীবিকার প্রয়োজনের বাইরে আত্মার উৎকর্যের জন্যে মানুষ যা-কিছু চিন্তা করে, কর্ম করে, তার কোনো অর্থই থাকে না । এই সত্যকে ক্ষণে ক্ষণে স্পর্শ করি আমাদের সংকল্পে, আমাদের ধ্যানে, আমাদের আদর্শে । সেই অভাবনীয় পূর্ণকে দেখতে পাই দুঃখের দীপ্তিতে, মৃত্যুর গীেরবে । সে আমাদের জ্ঞানকে ঘরছাড়া করে বড়ো ক্ষেত্রে মুক্তি দিয়ে:ে, নইলে পরমাণুতত্ত্বের চেয়ে পাকপ্ৰণালী মানুষের কাছে অধিক আদর পেত। সীমাবদ্ধ সৃষ্টিকে মানুষ প্রত্যক্ষ দেখছে, তাকে ব্যবহার করছে ; কিন্তু তার মন বলছে, এই সমস্তেরই সত্য রয়েছে সীমার অতীতে- এই সীমাকে যদি প্রশ্ন করি। তার শেষ উত্তর পাই নে এই সীমার মধ্যেই { ছন্দোগ্য উপনিষদে। কথিত আছে, ক্ষত্রিয় রাজা প্রবাহণের সামনে দুই ব্ৰাহ্মণ তর্ক তুলেছিলেন, সামগানের মধ্যে যে রহস্য আছে তার প্রতিষ্ঠা কোথায় । দালভ্য বললেন, “এই পৃথিবীতেই ।” স্কুল প্রত্যক্ষই সমস্ত রহস্যের চরম আশ্রয়, বোধ করি । দালাভের এই ছিল মত । প্রবাহণ বললেন, “তা হলে তোমার সত্য তো অন্তবান হল, সীমায় এসে ঠেকে গেল যে ” ক্ষতি কী তাতে । ক্ষতি এই যে, সীমার মধ্যে মানুষের জিজ্ঞাসা অসমাপ্ত থেকে যায় । কোনো সীমাকেই মানুষ চরম বলে যদি মানত তা হলে মানুষের ভৌতিক বিজ্ঞানও বহুকাল পর্বেই ঘাটে নোঙর ফেলে যাত্রা বন্ধ করত । একদিন পণ্ডিতেরা বলেছিলেন, ভৌতিক বিশ্বের মূল উপাদানস্বরূপ আদিভূতগুলিকে তারা একেবারে কোণঠেসা করে ধরেছেন, একটার পর একটা আবরণ খুলে এমন-কিছুতে ঠেকেছেন যাকে আর বিশ্লেষণ করা যায় না । বললে কী হবে । অন্তরে আছেন প্রবাহণ রাজা, তিনি বহন করে নিয়ে চলেছেন মানুষের সব প্ৰশ্নকে সীমা থেকে দূরতর ক্ষেত্রে । তিনি বললেন, অপ্রতিষ্ঠিতং বৈ কিল তে সাম, অন্তবাদ বৈ কিল তে সাম । আদিভূতের যে বস্তুসীমায় প্রশ্ন এসে থেমেছিল সে সীমাও পেরোল। আজ মানুষের চরম ভৌতিক উপলব্ধি পীেছল গাণিতিক চিহ্নসংকেতে, কোনো বোধগম্যতায় নয় । একদিন আলোকের তত্ত্বকে মানুষ বোধগম্যতার পরপারেই স্থাপন করেছিল। অদ্ভুত কথা বলেছিল, “ঈথারের ঢেউ' -জিনিসকেই । আলোকরূপে অনুভৱ করি । অথচ ঈথর যে কী আমাদের বোধের ভাষায় তার কোনো কিনারা পাওয়া যায় না । আলো, যা আমাদের দৃষ্টির ক্ষেত্রে সকল ভৌতিক জিনিসকে প্ৰকাশ করে দাড়ালো তা এমন-কিছুর প্রকাশ যা সম্পূর্ণই ভৌতিক ধর্মের অতীত, কেবল ব্যবহারে মাত্র জানা যায় যে তাতে নানা ছন্দের ঢেউ খেলে । কিন্তু, প্রবাহণের গণনা থামে না । খবর আসে, কেবল তরঙ্গধর্মী বললে আলোর চরিত্রের হিসাব পুরো মেলে না, সে কণিকাববীয়ও বটে । এই-সব স্ববিরোধী কথা মানুষের সহজ বুদ্ধির সহজ ভাষার সীমার বাইরেকার কথা । তবু বোধতীতের ডুবজলেও মানুষ ভয় পেলে না। পাথরের দেয়ালটাকেও বললে বিদ্যুৎ কণার নিরন্তর নৃত্য । সন্দেহ করলে না যে, হয়তো বা পাগল হয়ে গেছি । মনে করলে না, হয়তো প্ৰজা, যাকে বলে রােজন, সে মানস-সার্কাসের ডিগবাজি-খেলোয়াড় ; সব