পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VS by রবীন্দ্র-রচনাবলী করবার জন্যে । এমন-কিছুকে প্ৰকাশ, যাকে সে বলে থাকে “মানুষের প্রকাশ, জীবনযাত্রাতেও যে প্রকাশে নূ্যনতা ঘটলে মানুষ লজ্জিত হয়। সেই তার বাড়তি ভাগের প্রকাশ নিয়ে মানুষের যেমন দুঃসাধ্য প্ৰয়াস এমন তার সাধারণ প্রয়োজন মেটাবার জন্যও নয় । মানুষের মধ্যে যিনি বড়ো আছেন, আহারে বিহারেও পাছে তার অসম্মান হয় মানুষের এই এক বিষম ভাবনা । ঋজু হয়ে চলতে গিয়ে প্রতি মুহুর্তেই মানুষকে ভারাকর্ষণের বিরুদ্ধে মান বঁাচিয়ে চলতে হয় । পশুর মতো চলতে গেলে তা করতে হত না । মনুষ্যত্ব বাচিয়ে চলাতেও তার নিয়ত চেষ্টা, পদে পদেই নীচে পড়বার শঙ্কা । এই মনুষ্যত্ব বাচানোর দ্বন্দ্ব মানবধর্মের সঙ্গে পশুধর্মের দ্বন্দ্ব, অর্থাৎ আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের । মানুষের ইতিহাসে এই পশুও আদিম । সে টানছে তামসিকতায়, মৃঢ়তার দিকে । পশু বলছে, “সহজধর্মের পথে ভোগ করো ।” মানুষ বলছে, “মানবধর্মের দিকে তপস্যা করো ।” যাদের মন মন্থর- যারা বলে, যা আছে তাই ভালো, যা হয়ে গেছে তাই শ্ৰেষ্ঠ, তারা রইল জন্তুধর্মের স্থাবর বেড়াটার মধ্যে ; তারা মুক্ত নয়, তারা স্বভাব থেকে ভ্ৰষ্ট । তারা পূর্বসঞ্চিত ঐশ্বৰ্যকে বিকৃত করে, নষ্ট করে । মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে ; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বাগত বিরাটে । এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না । মানুষ নিজেকে জানে, তদদূরে তদ্বস্তিকে চ— সে দূরেও বটে, সে নিকটেও । সেই দূরের মানুষের দাবি নিকটের মানুষের সব-কিছুতেই ছাড়িয়ে যায় । এই অপ্রত্যক্ষের দিকে মানুষের কল্পনাবৃত্তি দৌত্য করে । ভুল করে বিস্তর, যেখানে থই পায় না। সেখানে অদ্ভুত সৃষ্টি দিয়ে ফাক ভরায় ; তবুও এই অপ্রতিহত প্ৰয়াস সত্যকেই প্ৰমাণ করে, মানুষের এই একটি আশ্চর্য সংস্কারের সাক্ষ্য দেয় যে, যেখানে আজও তার জানা পৌঁছয় নি। সেখানেও শেষ হয় নি। তার জানা । গাছে গাছে ঘর্ষণে আগুন জ্বলে । জ্বলে বলেই জ্বলে, এই জেনে চুপ করে থাকলে মানুষের বুদ্ধিকে দোষ দেওয়া যেত না । জানিবার নেই বলেই জানা যাচ্ছে না, এ কথাটা সংগত নয় তো কী । কিন্তু, মানুষ ছেলেমানষের মতো বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, ঘর্ষণে আগুন জ্বলে কেন । বৃদ্ধির বেগার-খাটুনি শুরু হল । খুব সম্ভব গোড়ায় ছেলেমানুষের মতোই জবাব দিয়েছিল ; হয়তো বলেছিল, গাছের মধ্যে একটা রাগী ভূত অদৃশ্যভাবে বাস করে, মার খেলে সে রেগে আগুন হয়ে ওঠে । এইরকম সব উত্তরে মানুষের পুরাণ বোঝাই-করা । যাদের শিশুবুদ্ধি কিছুতেই বাড়তে চায় না। তারা এইরকম উত্তরকে আঁকড়ে ধরে থাকে । কিন্তু, অল্পে-সন্তুষ্ট মৃঢ়তার মাঝখানেও মানুষের প্রশ্ন বাধা ঠেলে ঠেলে চলে । কাজেই উনুন ধরাবার জন্যে আগুন জ্বালতে মানুষকে যত চেষ্টা করতে হয়েছে তার চেয়ে সে কম চেষ্টা করে নি ‘আগুন জ্বলে কেন তার অনাবশ্যক উত্তর বের করতে । এ দিকে হয়তো উনুনের আগুন গেছে নিবে, হাড়ি চড়ে নি, পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলছে, প্রশ্ন চলছেই— আগুন জ্বলে কেন । সাক্ষাৎ আগুনের মধ্যে তার উত্তর নেই, উত্তর আছে প্ৰত্যক্ষ আগুনকে বহুদূরে ছাড়িয়ে । জন্তু-বিচারক মানুষকে কি নির্বোধি বলবে না. আমরা পতঙ্গকে যেমন বলি মূঢ়, বার বার যে পতঙ্গ আগুনে বঁাপ দিয়ে পড়ে ? এই অদ্ভুত বুদ্ধির সকলের চেয়ে স্পর্ধা প্ৰকাশ পায় যখন মানুষকে সে ঠেলা দিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে, “তুমি আপনি কে ” এমন কথা বলতেও তার বাধে না যে, “মনে হচ্ছে বটে তুমি আছ কিন্তু সত্যই তুমি আছ কি, তুমি আছ কোথায় ।” উপস্থিতমত কোনো জবাব না খুঁজে পেয়ে তাড়াতাড়ি যদি বলে বসি “আছি দেহধমে” অমনি অন্তর থেকে প্রবাহণ রাজা মাথা নেড়ে বলবেন, ওখানে প্রশ্নের শেষ হতে পারে না । তখন মানুষ বললে, ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াম- মানবধর্মের গভীর সত্য নিহিত আছে গোপনে । আমার “এই আমি আছে প্ৰত্যক্ষে, “সেই আমি আছে অপ্ৰত্যক্ষে । কথাটা স্পষ্ট করে বুঝে দেখবার চেষ্টা করা যাক । এই-যে জল, এই-যে স্থল, এই-যে এটা, এই-যে ওটা, যতী-কিছু পদার্থকে নির্দেশ করে বলি “এই-যে, এই-সমস্তই ভালো করে জেনে-বুঝে নিতে হবে, নইলে ভালো করে বঁাচা যায় না । কিন্তু