পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VCO রবীন্দ্র-রচনাবলী অর্থ থেকে হীন হওয়া । নাগরি শব্দ বলতে যদি citizen না বুঝিয়ে Hibertine বোঝায় তা হলে বলতে হয়, নাগরি শব্দ। আপনি সত্য অর্থ হতে হীন হয়ে গেছে । তেমনি একান্তভাবে প্রোয়কে অবলম্বন করলে, মানুষ বলতে যা বোঝায় সেই সত্য হীন হয়ে যায় । নিজের মধ্যে সর্বকালীন বিশ্বভূমীন মনুষ্যধর্মের উপলব্ধিই সাধুতা, হীনতা সেই মহামানবের উপলব্ধি থেকে বিচ্যুত হওয়া । প্ৰাকৃতিক স্বভাবের উপরেও মানুষের আত্মিক স্বভাব যদি না থাকত তা হলে এ-সব কথার অর্থ থাকত না । ডিমের মধ্যেই পাখির প্রথম জন্ম । তখনকার মতো সেই ডিমটাই তার একমাত্র ইদম । আর-কিছুই সে জানে না । তবু তার মধ্যে একটা প্রবর্তনা আছে বাইরের অজানার মধ্যে সার্থকতার দিকে । সেই সার্থকতা- নেদং যদিদমুপাসতে । যদি খোলাটার মধ্যেই একশো বছর সে বেঁচে থাকত তা হলে সেটাকেই বলা যেত তার মহতী বিনষ্টি । মানুষের সাধনাও এক স্বভাব থেকে স্বভাবাস্তরের সাধনা । ব্যক্তিগত সংস্কার ছাড়িয়ে যাবে তার জিজ্ঞাসা, তবেই বিশ্বাগত জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হবে তার বিজ্ঞান ! ব্যক্তিগত স্বাের্থও জড়প্রথাগত অভ্যাস কাটিয়ে যাবে তার প্রয়াস, তবেই বিশ্বাগত কর্মের দ্বারা সে হবে বিশ্বকৰ্মা ; অহংকারকে ভোগাশক্তিকে উত্তীর্ণ হবে তার প্ৰেম, তবেই বিশ্বাগত আত্মীয়তায় মানুষ হবে মহাত্মা । মানুষের একটা স্বভাবে আবরণ, অন্য স্বভাবে মুক্তি । জ্যোতিবিদ দেখলেন, কোনো গ্ৰহ আপনি কক্ষপথ থেকে বিচলিত ; নিঃসন্দেহ মনে বললেন, অন্য কোনো অগোচর গ্রহের অদৃশ্য শক্তি তাকে টান দিয়েছে ! দেখা গেল, মানুষেরাও মন আপন প্ৰকৃতিনির্দিষ্ট প্ৰাণধারণের কক্ষপথ যথাযথ আবৃত্তি করে চলছে না ! অনিদিষ্টের দিকে, স্বভাবের অতীতের দিকে ঝুঁকছে। তার থেকে মানুষ কল্পনা করলে দেবলোক । বললে, আদেশ সেইখানকার, আকর্ষণ সেখান হতে । কে সেই দেবলোকের দেবতা তা নিয়ে মানুষে মানুষে হানাহানি চলেছে । যিনিই হোন, তাকে দেবতাই বলি আর যাই বলি, মানুষকে জীবসীমার মধ্যে কিছুতেই স্থির থাকতে निcनन नां । সমুদ্র চঞ্চল হল । জোয়ার-ভাটার ওঠাপড়া চলছেই । চাদ না দেখা গেলেও সমুদ্রের চাঞ্চলোই চাদের আহবান প্ৰমাণ হত । বাচাঁবার চেষ্টাতেও মানুষ অনেক সময় মরে । যে ক্ষুধা তার অস্তরে নিঃসংশয়, তার লক্ষ্য যে তার বাইরেও সত্য সে কথাটা সদ্যোজাত শিশুও স্বতই জানে । মানুষের প্ৰাণাস্তিক উদ্যম দেখা গেছে এমন কিছুর জন্যে যার সঙ্গে বাচাঁবার প্রয়োজনের কোনো যোগই নেই । মৃত্যুকে ছাড়িয়ে আছে যে প্ৰাণ সেই তাকে দুঃসাহসের পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে । ভৌতিক প্রাণের পথে প্ৰাণীর নিজেকে রক্ষা ; আর এ পথে আত্মবানের আত্মাকে রক্ষা নয়, আত্মাকে প্ৰকাশ । বৈদিক ভাষায় ঈশ্বরকে বলেছে আবিঃ, প্রকাশস্বরূপ । তার সম্বন্ধে বলেছে, যস্য নাম মহদযশ: | তার মহাদযশই তার নাম, তার মহৎ কীর্তিতেই তিনি সত্য । মানুষের স্বভাবও তাই– আত্মাকে প্ৰকাশ । বাইরে থেকে খাদ্যবস্তু গ্ৰহণ করার দ্বারাই প্ৰাণী আপনাকে রক্ষা করে, বাইরে আপনাকে উৎসর্গ করার দ্বারাই আত্মা আপনাকে প্ৰকাশ করে । এইখানে প্রকৃতিকে ছাড়িয়ে গিয়ে সে আপনাকে ঘোষণা করে । এমন-কি, বর্বর দেশের মানুষও নিজেকে প্ৰকাশ করার চেষ্টায় প্রকৃতিকে লঙঘন করতে চায় । সে নাক কুঁড়ে মস্ত এক শলা দিয়েছে চালিয়ে । উখো দিয়ে দাত ঘষে ঘষে ছুচোলো করেছে । শিশুকালে তক্তা দিয়ে চেপে বিকৃত করেছে মাথার খুলি, বানিয়েছে বিকটাকার বেশভূষা । এই-সব উৎকট সাজে-সজ্জায় অসহ্য কষ্ট মেনেছে ; বলতে চেয়েছে, সে নিজে সহজে যা তার চেয়ে সে বড়ো । সেই তার বড়ো-আমি প্ৰকৃতির বিপরীত । যে দেবতাকে সে আপনি আদর্শ বলে মানে সেও এমনি অদ্ভুত ; তার মহিমার প্রধান পরিচয় এই যে, সে অপ্রাকৃতিক । প্রকৃতির হাতে পালিত তবু প্ৰকৃতিকে দুয়ো দেবার জন্যে মানুষের এই যেন একটা ঝগড়াটে ভাব । ভারতবর্ষেও দেখি, কত লোক, কেউ বা উদ্ধর্ববাহু, কেউ বা কণ্টকশয্যায় শয়ান, কেউ বা অগ্নিকুণ্ডের দিকে নতশীর্ষ । তারা জানাচ্ছে, তারা শ্রেষ্ঠ, তারা সাধু, কেননা তারা অস্বাভাবিক । আধুনিক পাশ্চাত্য দেশেও কত লোক নিরর্থক কৃচ্ছসাধনের গৌরব করে । তাকে বলে ‘রেকর্ড ব্ৰেক' করা, দুঃসাধ্যতার পূর্ব-অধ্যবসায় পার হওয়া ।