পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NyC) 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সত্তামাত্রকে যে ভাবে যেখানেই স্বীকার করি সেটা মানুষের মনেরই স্বীকৃতি । এই কারণেই দোষারোপ করে মানুষের মন স্বয়ং যদি তাকে অস্বীকার করে, তবে শূন্যতাকেই সত্য বলা ছাড়া উপায় থাকে না । এমন নাস্তিবাদের কথাও মানুষ বলেছে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক তা বললে তার ব্যাবসা বন্ধ করতে হয় । বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতায় আমরা যে জগৎকে জানি বা কোনোকালে জানিবার সম্ভাবনা রাখি সেও মানবজগৎ । অর্থাৎ, মানুষের বুদ্ধির, যুক্তির কাঠামোর মধ্যে কেবল মানুষই তাকে আপনি চিন্তার আকারে আপনি বোধের দ্বারা বিশিষ্টতা দিয়ে অনুভব করে । এমন কোনো চিত্ত কোথাও থাকতেও পারে যার উপলব্ধ জগৎ আমাদের গাণিতিক পরিমাপের অতীত, আমরা যাকে আকাশ বলি সেই আকাশে যে বিরাজ করে না । কিন্তু, যে জগতের গৃঢ় তত্ত্বকে মানব আপন অন্তনিহিত চিন্তাপ্ৰণালীর দ্বারা মিলিয়ে পাচ্ছে তাকে অতিমানবিক বলব কী করে । এইজন্যে কোনো আধুনিক পণ্ডিত বলেছেন, বিশ্বজগৎ গাণিতিক মনের সৃষ্টি । সেই গাণিতিক মন তো মানুষের মনকে ছাড়িয়ে গেল না । যদি যেত তবে এ জগতের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আমরা জানতেই পারতুম না, যেমন কুকুর বিড়াল কিছুতেই জানতে পারে না । যিনি আমাদের দর্শনে শাস্ত্ৰে সগুণ ব্ৰহ্ম তার স্বরূপসম্বন্ধে বলা হয়েছে সর্বেন্দ্ৰিয়গুণাভাসমা । অর্থাৎ মানুষের বহিরিন্দ্ৰিয়-অন্তরিান্দ্ৰিয়ের যত-কিছু গুণ তার আভাস তারই মধ্যে । তার অর্থই এই যে, মানবব্রহ্ম, তাই তার জগৎ মানবজগৎ । এ ছাড়া অন্য জগৎ যদি থাকে তা হলে সে আমাদের সম্বন্ধে শুধু যে আজই নেই তা নয়, কোনো কালেই নেই। এই জগৎকে জানি আপনি বোধ দিয়ে । যে জানে সেই আমার আত্মা । সে আপনাকেও আপনি জানে । এই স্বপ্ৰকাশ আত্মা এক নয় । আমার আত্মা, তোমার আত্মা, তার আত্মা, এমন কত আত্মা । তারা যে এক আত্মার মধ্যে সত্য তাকে আমাদের শাস্ত্ৰে বলেন পরমাত্মা । এই পরমাত্মা মানবপরমাত্মা, ইনি সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ । ইনি আছেন সর্বদা জনে-জনের হৃদয়ে । বলা হয়েছে বটে, আমাদের সকল ইন্দ্ৰিয়গুণের আভাস এর মধ্যে, কিন্তু এতেই সব কথা শেষ হল না । এক আত্মার সঙ্গে আর-এক আত্মার যে সম্বন্ধ সকলের চেয়ে নিবিড়, সকলের চেয়ে সত্য, তাকেই বলে প্ৰেম । ভৌতিক বিশ্বের সঙ্গে আমাদের বাস্তব পরিচয় ইন্দ্ৰিয়বোধে, আত্মিক বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সত্য পরিচয় প্ৰেমে । আত্মিক বিশ্বের পরিচয় মানুষ জন্মমুহুর্তেই আরম্ভ করেছে পিতামাতার প্ৰেমে । এইখানে অপরিমেয় রহস্য, অনির্বচনীয়ের সংস্পর্শ । প্রশ্ন উঠল মনে, এই পিতামাতার সত্য কোথায় প্রতিষ্ঠিত । দালভ্য যদি উত্তর করেন, এই পৃথিবীর মাটিতে প্রবাহণ মাথা নেড়ে বলবেন, যিনি পিতৃতমঃ পিতৃণাম, সকল পিতাই র্যার মধ্যে পিতৃতম হয়ে আছেন, তারই মধ্যে । মাটির অর্থ বুঝতে পারি বাহির থেকে তাকে নেড়েচেড়ে দেখে, পিতামাতার রহস্য বুঝতে পারি আপনারই আত্মার গভীরে এবং সেই গভীরেই উপলব্ধি করি পিতৃতমকে । সেই পিতৃতম বিশেষ কোনো স্বগে নেই, বিশেষ কোনো দেশকালে বদ্ধ ইতিহাসে নেই, ইনি বিশেষ কোনো একটি মানুষে একদা অবতীর্ণ নন, ইনি প্রেমের সম্বন্ধে মানবের ভূতভবিষ্যৎকে পূৰ্ণ করে আছেন নিখিল মানবলোকে । আহবান করছেন দুৰ্গম পথের ভিতর দিয়ে পরিপূর্ণতার দিকে, অসত্যের থেকে সত্যের দিকে, অন্ধকার থেকে জ্যোতির দিকে, মৃত্যুর থেকে অমৃতের দিকে, দুঃখের মধ্য দিয়ে, তপস্যার মধ্য দিয়ে । r এই আহবান মানুষকে কোনোকালে কোথাও থামতে দিলে না, তাকে চিরপথিক করে রেখে দিলে । ক্লান্ত হয়ে যারা পথ ছেড়ে পাকা করে ঘর বেঁধেছে। তারা আপন সমাধিঘর রচনা করেছে । মানুষ যথার্থই অনাগরিক । জন্তুরা পেয়েছে বাসা, মানুষ পেয়েছে পথ । মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ র্যারা তারা পথনির্মাতা, পথপ্ৰদশক । বুদ্ধকে যখন কোনো একজন লোক চরমতত্ত্বের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিল। তিনি বলেছিলেন, “আমি চরমের কথা বলতে আসি নি, আমি বলব পথের কথা ।” মানুষ এক যুগে যাকে আশ্রয় করছে আর-এক যুগে উন্মাদের মতো তার দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে পথে । এই—যে বারে বারে ঘর ভেঙে দিয়ে চলবার উদামতা, যার জন্যে সে প্রাণপণ করে, এ প্রমাণ করছে কোন সত্যকে । সেই সত্য সম্বন্ধেই উপনিষদ বলেন, মনসো জবীয়ো নৈনদেবা। আধুবন পূর্বমর্ষৎ । তিনি মনকে ইন্দ্ৰিয়াকে ছাড়িয়ে চলে গেছেন । ছাড়িয়ে যদি না যেতেন। তবে পদে পদে মানুষও আপনাকে ছাড়িয়ে