পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম WWOGł যেত না । অথর্ববেদ বলেছেন, এই আরো’র দিকে, এই ছাডিয়ে যাবার দিকে মানুষের শ্ৰী, তার ঐশ্বৰ্য, তার মতত্ত্ব । তাই মানবদেবতার সম্বন্ধে এই কথা শুনি যদ যদা বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্ৰীমদুর্জিতমেব বা তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহাংশসম্ভবম | যা কিছুতে ঐশ্বৰ্য আছে, শ্ৰী আছে, শ্রেষ্ঠতা আছে, সে আমারই তেজের অংশ থেকে সস্তৃত । বিশ্বে ছোটো বড়ো নানা পদার্থই আছে । থাকা-মাত্রের যে দাম তা সকলের পক্ষেই সমান । নিছক অস্তিত্বের আদর্শে মাটির ঢেলার সঙ্গে পদ্মফুলের উৎকর্ষ-অপকর্ষের ভেদ নেই। কিন্তু, মানুষের মনে এমন একটি মূল্যভেদের আদর্শ আছে যাতে প্রয়োজনের বিচার নেই, যাতে আয়তনের বা পরিমাণের তীেল চলে না । মানুষের মধ্যে বস্তুর অতীত একটি অহৈতুক পূর্ণতার অনুভূতি আছে, একটা অন্তরতম সার্থকতার বোধ । তাকেই সে বলে শ্রেষ্ঠতা । অথচ, এই শ্রেষ্ঠতা সম্বন্ধে মতের ঐক্য তো দেখি নে । তা হলে সেটা যে নৈর্ব্যক্তিক শাশ্বত সত্যে প্রতিষ্ঠিত, এ কথা বলা যায় কী করে । জ্যোতির্বিদ দূরবীন নিয়ে জ্যোতিষ্কের পর্যালোচনা করতে চান, কিন্তু তার বাধা বিস্তর । আকাশে আছে পৃথিবীর ধুলো, বাতাসের আবরণ, বাম্পের অবগুণ্ঠন, চাব দিকে নানাপ্রকার চঞ্চলতা । যন্ত্রের ক্রটিও অসম্ভব নয়, যে মন দেখছে তার মধ্যে আছে পূর্বসংস্কারের আবিলতা । ভিতর-বাহিরের সমস্ত ব্যাঘাত নিরস্ত করলে বিশুদ্ধ সত্য পাওয়া যায় । সেই বিশুদ্ধ সত্য এক, কিন্তু বাধাগ্ৰস্ত প্রতীতির বিশেষত্ব অনুসারে ভ্রান্ত মত বহু । পুরোনো সভ্যতার মাটিচাপা ভাঙাচোরা চিহ্নশেষ উদ্ধার করলে তার মধ্যে দেখা যায় আপন শ্রেষ্ঠতাকে প্ৰকাশ করবার জন্যে মানুষের প্রভূত প্ৰয়াস । নিজের মধ্যে যে কল্পনাকে সকল কালের সকল মানুষের বলে সে অনুভব করেছে তারই দ্বারা সর্বকালের কাছে নিজের পরিচয় দিতে তার কত বল কত কৌশল । ছবিতে, মূর্তিতে, ঘরে, ব্যবহারের সামগ্ৰীতে, সে ব্যক্তিগত মানুষের খেয়ালকে প্রচার করতে চায় নি— বিশ্বাগত মানুষের আনন্দকে স্থায়ী রূপ দেবার জন্যে তার দুঃসাধ্য সাধনা ৷ মানুষ তাকেই জানে শ্রেষ্ঠতা যাকে সকল কাল ও সকল মানুষ স্বীকার করতে পারে । সেই শ্রেষ্ঠতার দ্বারা মানুষ আত্মপরিচয় দিয়ে থাকে । অর্থাৎ, আপনি আত্মায় সকল মানুষের আত্মার পরিচয় দেয় । এই মাঝখানেই সেই বিনষ্টির লক্ষণ সহসা এসে দেখা দেয় যখন মদান্ধি স্বাথান্ধ মানুষ চিরমানবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে । পাশ্চাত্য মহাদেশে কি সেই লক্ষণ আজ দেখা দেয় নি । সেখানে বিজ্ঞান আছে, বাহুবল আছে, অর্থবল আছে, বুদ্ধিবল আছে, কিন্তু তার দ্বারাও মানুষ রক্ষা পায় না । স্বাজাত্যের শিখরের উপরে চড়ে বিশ্বগ্রাসী লোভ যখন মনুষ্যত্বকে খর্ব করতে স্পর্ধা করে, রাষ্ট্রনীতিতে নিষ্ঠুরতা ও ছলনার সীমা থাকে না, পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা এবং সংশয় যখন নিদারুণ হিংস্রতায় শান দিতে বসে, তখন মানবের ধর্ম আঘাত পায় এবং মানবের ধর্মই মানুষকে ফিরে আঘাত করে । এ কোনো পৌরাণিক ঈশ্বরের আদিষ্ট বিধির বিরুদ্ধে 'বিদ্রোহের কথা নয় । এই-সব আত্মম্ভরীরা আত্মহনো জনাঃ । এরা সেই আত্মাকে মারে যে আত্মা স্বদেশের বা স্বগোষ্ঠীর মধ্যে বদ্ধ নয়, যে আত্মা নিত্যকালের বিশ্বজনের । একলা নিজেকে বা নিজেদেরকে বড়ো করবার চেষ্টায় অন্য-সকল প্ৰাণীরই উন্নতি ঘটতে পারে, তাতে তাদের সত্যদ্রোহ ঘটে না ; কিন্তু মানুষের পক্ষে সেইটেই অসত্য, অধর্ম, এইজন্যে সকলপ্রকার সমৃদ্ধির মাঝখানেই তার দ্বারাই মানুষ সমূলেন বিনশ্যতি । বিশুদ্ধ সত্যের উপলব্ধিতে বিশ্বমানবমনের প্রকাশ, এ কথা স্বীকার করা সহজ ; কিন্তু রসের - অনুভূতিতে সেই বিশ্বমনকে হৃদয়ংগম করি কি না, এ নিয়ে সংশয় জন্মাতে পারে । সৌন্দর্যে আনন্দবোধের আদর্শ দেশকলপাত্ৰভেদে বিচিত্র যদি হয় তবে এর শাশ্বত আদর্শ কোথায় । অথচ, বৃহৎ কালে মেলে দিয়ে মানুষের ইতিহাসকে যখন দেখি তখন দেখতে পাই, শিল্পসৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠতা সম্বন্ধে সকল কালের সকল সাধকদের মন মেলবার দিকেই যায় । এ কথা সত্য যে, নিশ্চিতভাবে প্ৰত্যেক O 8